সৌরভ ভট্টাচার্য
24 March 2019
ঝাঁ চকচকে বারান্দা। একটা মোড়ার উপর পা তুলে বসে থাকতে থাকতে পা-টা ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সবে সাড়ে তিনটে। মালতীর আসতে আরো ঘন্টা দুই। ঘুম পাচ্ছে না। আজ অনেক বেলা অবধি ঘুমানো হয়ে গেছে। মাথাটা পিছনে টানটান করে দিয়ে খবরের কাগজটা মেঝেতে ফেলে দিল। বারান্দাটা টানা। গাছের ছায়ায় অন্ধকার অন্ধকার মত।
ঘুমিয়ে পড়ল অলোকেশ। গরমের দুপুর। একটা ঘুঘু এক নাগাড়ে ডেকে চলছে। বড় রাস্তাটা বাড়ির সামনে বাগান পেরিয়ে। অলোকেশ রিটায়ার করেছে। রেলে কাজ করত। গড়িয়ার এই বাড়িটা পৈতৃক। অলোকেশ বিপত্নীক। নীচের ঘরগুলোতে দুটো ভাড়া থাকে। এখন কেউ নেই। একজন ছেড়ে চলে গেছে, আরেকজন লাভা, লোলেগাঁও বেড়াতে গেছে।
অলোকেশের মাথার পিছনে একটা দেওয়াল। একটা ক্যালেণ্ডার ঝুলছে। আমি চাইলেই দুলিয়ে দিতে পারি, কিন্তু দোলাব না। আমি এই বারান্দা পেরিয়ে ঠাকুরঘরের পাশের ঘরেই থাকি। আগে ভাড়া দেওয়া হত ঘরটা। এখন দেওয়া হয় না। আমার আত্মহত্যার পর থেকেই তালা দেওয়া ঘরটায়।
অলোকেশের স্ত্রী মারা যায় ছাদ থেকে পড়ে। কেউ কেউ ভাবে ওটা আমার কাজ। আদৌ তা নয়। বিশুদ্ধ দুর্ঘটনা। তবে অলোকেশবাবুও আজ রাতেই মারা যাবেন। এগারোটা পেরোবে না। আমার মনটা খারাপ। আমি নিঃসঙ্গ হতে চলেছি। কয়েকটা বেড়াল ছাড়া আর কিছু থাকছে না। আর বাড়িটা যদি ভেঙে দেয়... মালতী আসছে....
অলোকেশ চা খাচ্ছে। বুকটা অল্প অল্প চিনচিনে ব্যথা শুরু হল আজ আবার। অম্বল থেকেই হচ্ছে ভেবে অলোকেশ চা'টা ঠাণ্ডা করে খাবে ঠিক করল। মালতী'র বাসন মাজার আওয়াজ আসছে।
আমি এই সময়টায় ছাদে হাঁটি। উড়িও বলতে পারেন। বেঁচে থাকতে থাকতেই এই অভ্যাসটা। কেন আত্মহত্যা করলাম? ওই চিটফাণ্ড কেস। এখন আমার সামনে জীবন-মরণ রেখাটা ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের মত। এককালে ওদিকেই ছিলাম। এখন এইদিকে। এখন আমার হাঁটতে ভালো লাগছে। মালতী অলোকেশের জন্য শেষ রুটি বেলছে, যদিও ও জানে না। সে রুটি খাওয়ার সময়ও অলোকেশ পাবে কিনা কে জানে। এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেল। ভাবছি একটু গঙ্গার পাড় থেকে ঘুরে আসি। ন'টার মধ্যেই চলে আসব।
অলোকেশের ব্যথাটা বাড়ছে। বাঁহাতটাও কাঁধের কাছ থেকে চিনচিন করছে। নাক্সভোমের কয়েকটা বড়ি খেয়ে অলোকেশ টিভিটা চালালো। ঘাম হচ্ছে অল্প অল্প। সাড়ে সাতটা বাজে।
চলে এলাম। ভাল্লাগলো না। অলোকেশ বেঁচে এখনও। আমি যেদিন মারা গেলাম সেদিন ও জাস্ট ফিরেছে মুম্বাই থেকে। ওর ছেলে থাকে মুম্বাইতে। কি বিরক্তি আমার বডিটা বার করার সময়। পুলিশ, পার্টির লোক, সংবাদ মাধ্যম, বুঝছেনই তো। যা তা একটা ব্যপার। শালা বোঝ এখন। তোর বডি তো কাল মালতী এসে দেখবে। তার আগে?
অলোকেশ আর আমি – অর্থনীতির দুইদিক। গঙ্গার দুই পাড়। ওর দিকে জোগান, আমার দিকে ভাঙন। আমি মানুষকে ধরে ধরে পয়সা বানানোর চেষ্টায় সারাজীবন কাটালাম, ও পয়সার উপর বসে মানুষের ঘাড়ের উপর বসে বসে জীবন কাটিয়ে গেল। একটা কুটো নিজের থেকে নাড়ত না। লোকে বলত ছুঁচিয়ে দেওয়ার জন্যেও নাকি অলোকেশের লোক আছে।
দশটা বাজল। অলোকেশ খেলো না কিছু। ওর গা গুলাচ্ছে।
আসলে আমি আর অলোকেশ এক জায়গায় এক জানেন। আমরা দু'জনেই ভীষণ নিঃসঙ্গ। ঠিক নিঃসঙ্গ শব্দটা দিয়ে বোঝানো যায় না হয়ত। অলোকেশ আর আমি সারাজীবন মানুষের সাথেই কাটালাম। কিন্তু মানুষ নিয়ে কাটালাম না। আমরা ব্যবহার করে গেলাম মানুষকে সারাজীবন। ও নিজের ভোগের জন্য, আর আমি সিঁড়িতে ওঠার জন্য। আমাদের কোনো বন্ধু ছিল না জানেন। আমরা আমাদের নিজেদের বন্ধুও ছিলাম না। আমি মারা গেছি বলে বলছি না, মানুষের একটা আত্মা থাকেই। বেঁচে থাকতে সেই আত্মাটা যত কাছের হয়, মরে গেলে সে শুধু হাওয়া, অস্তিত্বহীন অস্তিত্ব। অলোকেশের বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। দাঁড়ান আমি একটু ঘুরে আসি।
অলোকেশের চোখের সামনে সব ঝাপসা হতে শুরু করেছে। সেই ঝাপসা চোখেই মনে হল তার স্ত্রী যেন সামনে খাটে বসে তার দিকে তাকিয়ে। ওপাশে মা-বাবা সোফায় বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। রাধামাধব বলে যে চিটফাণ্ডের দালালটা তাদের বাড়ি সুইসাইড করেছিল সেও যেন দরজাটার পাশে দাঁড়িয়ে। কেউ কোনো কথা বলছে না। অলোকেশ নিজের নাড়ি দেখার চেষ্টা করল। প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে। বমি হয়ে গেল হড়হড় করে। মাথাটা কাত হয়ে ডানদিকে ঝুঁকে পড়েছে।
মারা গেল বুঝলেন। দাঁড়ান একটু কেঁদে নিই। আমার বুকটা টাটাচ্ছে। আসলে মানুষে মানুষে একটাই সম্পর্ক হয় জানেন, বন্ধুত্বের। বুঝিনি। মা’টা শালা না খেয়ে আমাদের চারভাইকে মানুষ করল। মানুষ করল বলতে লজ্জা লাগছে, বড় করল। আমার এক বন্ধু খগেন নিজের ঘড়ি বেচে আমার আমার কলেজের বই কিনে দিয়েছিল জানেন। মল্লিকা নিজের খাবারটা না খেয়ে আমায় দুপুরে খাওয়াত কলেজে। আমি শালা সব্বাইকে ল্যাং মেরেছি। আমার সামনে টাকাটাই বড় ছিল, তখন জমিয়েও ছিলাম বেশ কিছু টাকা। তারপর শরীরটা ভাঙতে শুরু করল, বেশ কিছু পলিসি ফেল করল কোম্পানির, অনেকগুলো বদভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে তখন, লাইফ স্টাইল কি... শালা... সব ফুস্ হয়ে গেল রাতারাতি জানেন... হঠাৎ দেখি একটা জলা জমিতে একা দাঁড়িয়ে... কেউ কোত্থাও নেই... খগেন কোথায় খোঁজ রাখিনি... মল্লিকার ফিগারটা অ্যাট্রাক্টিভ ছিল না বলে বিয়ে করলাম না... আর কাউকেই বিয়ে করলাম না... মনে হল বিয়ে মানে অনেকগুলো টাকা ব্লকেজ... তার চাইতে মস্তিতে জীবনটা কাটিয়ে দিই... টাকা থাকলেই সব থাকে...
- থাকে না রাধাগোবিন্দ...
- একি অলোকেশ দা... আপনি এই ডিপার্টমেন্টে?... এতো সুইসাইডিয়াল জোনের কেস!...
- আহা... জানি... আমার একটু দেরি আছে যেতে... আসলে আমিও ভালোবাসিনি কাউকে... তোমাদের বউদিকেও নয়... ওকে ঠেলেছিল মালতী...
- অলোকেশদা এই কেসটা কিন্তু আমি পাবলিককে বলিনি...
- জানি বলোনি... তোমারও যে কত পাড়ায় যাতায়াত ছিল তাও তো বলো নি... আসলে রাধাগোবিন্দ আমরা টাকায় মানুষ ভুলেছি... মানুষের উষ্ণতা বলতে উলঙ্গ শরীরে কামের দাপাদাপি বুঝেছি... উষ্ণ চোখে মানুষের হাতে হাত কোথায় রাখলাম বলো...? জীবন তাই আমাদের ক্ষমা করেনি রাধাগোবিন্দ... তুমিও একা, আমিও একা... পশুর মত একা... ঈশ্বরের মত একা... কিন্তু মানুষের তো একা থাকার কথা ছিল না রাধাগোবিন্দ...! টাকায় একা করল... মানুষকে ব্যবহার করতে শেখালো... আর কোন প্রাণী নিজেদের জাতকে এরকম নির্দয় ব্যবহার করে রাধাগোবিন্দ...? আমি তাহলে আসি... আপনারা রাধাগোবিন্দ'র সাথেই কথা বলুন...
- না দাদা, আপনি এগোন... আমি একটু কাশীপুর শ্মাশানের দিকে যাব। শুনেছি আজ রাতে মল্লিকাকেও নিয়ে আসছে...
আমি কাশীপুর শ্মশানে গেলাম। যাওয়ার আগে একটাই কথা... বেঁচে থাকতে যদি নিজের আত্মাকে চিনে নিতে না পারেন মরেও সুখ নেই জানবেন... আত্মা মানে বন্ধুত্বের জেদ... ব্যস... আসি... ভালো থাকবেন...