"আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচো। বাকি যা সে পরে ভাবা যাবে।"
মাষ্টার বাসে উঠে গেল। ছেলেটা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া বাসটার দিকে তাকিয়ে প্রথম যে কথাটা ভাবল, স্যারের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
দেখা সত্যিই আর হল না। উনি অন্য স্কুলে হেডমাস্টার হয়ে চলে গেলেন।
অনেকদিন পরে ছেলেটা আবার গ্রামে ফিরল। একা। তার পরিবার মুম্বাইতে থাকে। তার গ্রামের এমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। শুধু রাস্তাগুলো কালো পিচে ঢাকা সাপের মত শুয়ে। ধুলো ওড়ে না আর আগের মত।
কাঁচাপাকা চুলের ভিতর হাত ডুবিয়ে ধানক্ষেতের পাশে এসে দাঁড়ালো। সবুজ হয়ে আছে সামনেটা। একটা ফিঙে পাখি সামনের ঝোপে এসে বসল। এ ডাল ও ডাল বসে, খানিকবাদে আবার উড়ে গেল।
তাকে কেউ চেনে না এখন। সে-ও চেনে না কাউকে। একটা শব্দের মানে আবার বুঝে নিতে গ্রামে আসা --- আত্মসম্মান।
অনেকবার মনে হল কোথাও যেন কম্প্রোমাইজ করেছে। অনেকবার ডুবে গেছে যেন। কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আসলে আত্মসম্মানের মৃত্যু হয় না। চাপা দেওয়া যায়, এড়িয়ে যাওয়া যায়। চাপা পড়ে, দেবে গিয়েও সে দপ দপ করে, নাড়ির মত। তারপর সুযোগ পেলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বাকি সব পাওয়াগুলো তুচ্ছ তখন। কাল্পনিক ভয়টয় তুচ্ছ তখন। স্যারের সঙ্গে দেখা হলে একবার বলা যেত, সে আত্মসম্মানকে বারবার আবিষ্কার করেছে। তা যদি বাইরের জিনিস হত, আলগা জিনিস হত, তবে না হয় একবার হারালে একেবারেই যেত। এ তো আত্মার জিনিস, হারালে আবার খুঁজে নিতে হয়, নইলে তো নিজেই হারিয়ে যায় মানুষ....
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বুকের ভিতরটা অনেক হাল্কা। কয়েকটা হাতের আঙুল, কয়েকটা ঘোরানো সিঁড়ি ছেড়ে দিয়েছে আজই। মোবাইলটা সুইচ অফ্। সারা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের যোগাযোগ কি ঘনিষ্ঠ আজ! ভিতরে আজ যে যোগাযোগটা ফিরে পেয়েছে, সেটা মিস করছিল অনেকদিন। দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। আত্মসম্মানবোধ মলিন হয়েছে, কিন্তু ম্লান হয়ে যায়নি। আবার উজ্জ্বলতায় ফিরে আসবে, সে জানে....
হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে একটা বাস দাঁড়ালো। স্যার নামলেন বাস থেকে। তার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আমি জানতাম তুই আসবি, যে কথাটা বলতে আসবি সেটাও আমি জানি। কিন্তু এই কথাটা বুঝতে সারা জীবন লাগে। চল হাঁটবি। কোনদিকে হাঁটবি?
ছেলেটা বলল, যে রাস্তায় ধুলো.....
একটা মানুষ একা একা ধুলোয় মেখে হেঁটে যাচ্ছে। ধুলোয় যেন দু'জোড়া পায়ের ছাপ।