পটলা কয়েক হাজার গোত্তা খেয়ে, গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যখন জগন্নাথ মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ালো তখন সূয্যি মামা ফুল ভোল্টেজে মাথার উপর। এদিকে খালি পা। চাদ্দিকে মেলা কাজ হচ্ছে। মানে আরও উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু চটিখানা কোথায় খুললাম?
পটলার খিদে পাচ্ছে। এদিকে মন্দিরে আসার তাড়ায় ভালো করে বড় বাইরেটাও হয়নি। তায় সক্কালবেলা সাধুর উত্তাল ঝাড়ও খেয়েছে। খাবে নাই বা কেন। পটলা একে তেমন কেউকেটা নয়, আবার এদিকে মেলা আত্মবিশ্বাস। এ দুটো কি এক সঙ্গে কেউ সহ্য করে? মায় সাধারণ লোকেই সহ্য করে না, তো তেনারা তো আবার সাধকস্বভাব তেজোময় পুরুষ। পটলা গুগুলে দেখে পুরীতে দুটো জায়গা দেখাচ্ছে। একটা মঠ, দুই মিশন। কোনটায় যাবে? ফোন করল। সাধু বোঝালো। অটোতে উঠবে, অটোওয়ালা আরেক জায়গার নাম বলল। আবার ফোন করল। ব্যস। ওদিকে ভিসুভিয়াস জ্বলে উঠল। মনে হল ফোনের ভিতর থেকে সে সাধুর মঙ্গলময় হাত এসে এক্ষুনি ধড়ের থেকে মাথাটা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলবে। পাড়ার দাদারা চটে গেলে যে সব চার অক্ষর, দু অক্ষর বলে, সে শব্দ ক'টা বাদ দিয়ে তেমনই মেজাজে বেশ কিছুক্ষণ এটাসেটা বলে ফোন রেখে দিল ধড়াম করে। যা হোক, সকাল আটটাতেই যদি এই মেজাজ থাকে বেলা গড়ালে কি মেজাজে দাঁড়াবে ভেবে পটলা আর ওমুখো হল না। শাক্ত মতে পুজো হয়, আবার বলিটলি দিয়ে ফেললে বিপদ।
কিন্তু চটি কোনদিকে? পটলা মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে। বাঁয়ে যাবে, না ডাঁয়ে? পা পুড়ে যাচ্ছে। তায় চাদ্দিক খুঁড়েটুড়ে সব এবড়োখেবড়ো। পায়ে ফুটছে। উপায়? যা হোক, জয় জগন্নাথ বলে খালি পা চালিয়ে দিল পটলা। খালি মনে হচ্ছে আবার টিটেনাস নিতে হবে না তো? যত যায় তত রাস্তা যায় গুলিয়ে। এদিকে কানের কাছে হাজার একটা চলমান যন্ত্র গাঁ গাঁ করে হর্ন দিয়েই যাচ্ছে। দাদা পশ্চিম দুয়ার কোন দিকে? কেউ বলে বাঁদিকে গেলেও হয়, কেউ বলে ডান দিকে গেলেও হয়। আরে ভাই পৃথিবীটা যে গোল সে কে না জানে। কিন্তু কোনদিক দিয়ে গেলে রাস্তাটা সহজ হয় একটু বলে দিলে ভালো হয় না? কেউ বলে না। পটলার এদিকে ডাক এসেছে। হা জগন্নাথ, সামনে এ যে বড়দাণ্ড!
রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালো পটলা। একদিকে এক মহিলা ফুল বিক্রি করছে। থুড়ি ফুল না, পুজোর ছোটো ছোটো মাটির পাত্র, তাতে অনেক কিছু। কয়েকজন হৃষ্টপুষ্ট সুবেশ পাণ্ডা গপ্পো করছে। পটলা এখন যায় কোনদিকে? মন্দিরের দিকে তাকালো। পতাকা পতপত করে উড়ছে। চারদিকে সবাই মেলা ব্যস্ত। হইহই চলছে। একটা মানুষ যে রীতিমতো যন্ত্রণাক্লিষ্ট পায়ে, তলপেটের বায়না রোধ করে ঘেমেনেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারোর ভ্রুক্ষেপ নেই। একবার ভাবল ঠিক আছে, নিকুচি করেছে চটি, একটা টোটো নিয়ে হোটেলে ফেরা যাক। ও বাব্বা, এদিকে টোটো আসবে না, যেতে হবে সেই ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে ওই পশ্চিমের দিকেই।
উপায়? পটলা একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করল, এদিকে পায়খানা হ্যায়?
পুলিশের মুখটা দেখার মত হল। এদিকে ভক্তের ভিড়, ওদিকে রাস্তার যানজট, তায় হাই ভোল্টেজ সূয্যি মাথার উপর, আর এ মড়া এসেছে মাঝরাস্তায় হাগবে বলে…
কোনো রকমে একটা টিনের ঘর দেখিয়ে বলল, ওই যে….
মানে ওখানে হাগুন।
ওসব আর কি? চলমান হাগাখানা… থুড়ি… মোবাইল টয়লেট। পাগল! ওতে যায়? বসলাম আর গাড়ি করে হিড়হিড় করে নিয়ে গিয়ে মোহনায় ফেলুক আর কি!
কিন্তু চটি? ভায়া মুক্তির পথ না, আত্মজ্ঞান না, কেবল চটিজোড়া কোথায় খুললাম এই রাস্তাটা কেউ বলে দিবি না? যা হোক পটলা আবার হাঁটা লাগালো। কখনও পিচের রাস্তা, কখনও ফুটপাত, কখনও ভাঙাচোরা ঢিবি চড়ে উতরে এসে গেল পশ্চিম দ্বারে। ওই তো চটির জায়গা!
পটলার আবেগে চোখে জল এলো। চটি পায়ে দিল। এবং জুতা আবিষ্কার যে মনুষ্যপ্রজাতির একটা শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের মধ্যে পড়ে সে নিয়ে মনে মনে একটা স্তব রচনা করে ফেলল। এমন সময় কোথা থেকে এক কোকিল ডেকে উঠল। পটলা মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকালো। পায়ে চটি পরেই ভাগবতের সেই পঙক্তি ইয়াদ করল। নারদ মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, যদি সংসারে শান্তি চাও, তবে সন্তুষ্টির জুতো পায়ে গলিয়ে সংসারের কাঁটাপথে হেঁটে যাও। কষ্ট লাগবে না। এ পঙক্তি আগেও শুনেছে পটলা, তবে এত গভীরভাবে অনুভব করেনি। যার পায়ে যেমন মাপের জুতো তার তা-ই তো পায়ে দেওয়া উচিৎ। তবেই শান্তভাবে চলা যাবে।
পটলা জগন্নাথদেবকে গদগদভাবে প্রণাম জানালো। বলল, প্রভু হাগা হোক চাই না হোক, হাগা নিয়ে মনে অশান্তি যেন না হয়।
বলতে বলতেই পেটে মোচড় দিল। পটলা অবাক হল, মোচড় দিল বটে, কিন্তু নার্ভাস হল না। শান্তভাবে একটা টোটোতে গিয়ে বসল। তারপর চালককে বলল, শান্ত ভাবে স্বর্গদ্বারকু চালাইবা, মেলা ধাইকিড়িকিড়ি না করিবা, হাগা চাপছন্তি, তোমার সিটে যদি হাগন্তি, তবে বড় ঝামেলা হবন্তি….
টোটোওয়ালা বলল, বসুন….
পটলা বসল। চোখ বন্ধ করল। পেট থেকে পা কনকন করে উঠছে মাঝে মাঝে। চারদিকে গাঁ গাঁ করে বাইক, অটো, টোটো হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। পটলা কল্পনা করছে সমুদ্রের ঢেউ, তার উপর ভেসে যাচ্ছে পটলা, কলম্বাস একটা ছোটো ডিঙি করে ভাসছে আর বলছে, কৌঠি ভালো খাজা মিলিবা কহি পারিবু?.....
পটলার কপালে ঘাম। টোটো দাঁড়ালো। নাকে স্বর্গদ্বারের গন্ধ এলো। পটলা চোখ খুলল। হায় রে নশ্বর জীবন….. হায় রে তুচ্ছ হাগা… এই তো মনুষ্যজীবন….. ওই তো হোটেল…. এখন কি দরকার? এক কাপ চা!!
(ছবি: Suman Das)