সৌরভ ভট্টাচার্য
6 July 2020
আমাকে অনেকে মার্কার পেজের বাণ্ডিল কিনে দিয়েছে। সেই যাতে অল্প আঠা লাগানো থাকে। মানে বৈরাগ্যসূচক আঠা। যা বইয়ে চিপকে থাকে বটে, সিঁটিয়ে থাকে না। উঠতে বললেই ভদ্রমানুষের মত উঠে আসে, সংলগ্ন পাতার গায়ে 'রেখামাত্র চিহ্ন' না রেখে। আহা, যেন সন্ন্যাসীর মন। কিন্তু সে সবে আমার মন ভরে না। আমি সে সব গুছিয়ে রেখে আবার ছেঁড়া পাতার টুকরো খুঁজি, আবার বড় মোটা ফেলে দেওয়া পাতা পেলে তাকে চার-পাঁচ টুকরো করে পেনদানিতে জমিয়ে রাখি।
আমার আবার একটা বদভ্যাস আছে, কোনো বই যদি আমার প্রাণের খুব গভীরে এসে বসে গেল, তবে সেই বইয়ের মার্কারকে আমি অন্য বইতে নেওয়া পছন্দ করি না। কেন জানি সেই বইটার সাথে তার একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে মনে হয়, কতবার যেন সে আমার পথ চেয়ে বসে থেকেছে, অপেক্ষা করেছে, আমি এলেই বলে দেবে, "এই যে আমি এখানে, এই এত অবধি এগিয়ে ছিলে, এসো, তুমি এগোলে আমিও এগোই।"
তাই মার্কার যেন একটা স্মৃতিও হয়ে যায়। তাকে সেই বইয়ের সাথেই রেখে দিই, কিম্বা বিসর্জন দিই। কিন্তু না তো অন্য বইতে নিই, না সেই বই কাউকে দিলে তাকেও সেই মার্কার ব্যবহার করতে দিই না, মার্কারটা নিজের কাছে রেখে বইটাই শুধু দিই। ওই নির্দিষ্ট মার্কারের সাথে আমার কি সম্পর্ক সে বুঝবে কি করে? তাছাড়া মার্কারকে ব্যভিচারী হতে দিতে নেই।
কখনও যদি মার্কার হারিয়ে গেছে, কিভাবে যে দিশাহারা হই আমরা তা পাঠক মাত্রেই জানবেন। নিজের উপর রাগ, বইয়ের উপর রাগ, স্মৃতিশক্তির রেগেমেগে গুষ্ঠির তুষ্টি করা। এই সব তো আছেই।
অতএব এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মার্কার আমাদের কি অর্থে পথপ্রদর্শক, দোসর। পাঠের একান্ত নিবিড় মুহুর্তে আমার চোখে জল, আমার ভুরুর কুঁচকানি, আমার হাসি, আমার রাগ, আমার সংশয়, আমার দ্বন্দ্ব, আমার ভালোবাসা, ঈর্ষা, যৌনতা সব কিছুর সাক্ষী সে মার্কার। তার সাথে সম্বন্ধ কি আর এমনি মিছে? সেকি শুধু কাগজের টুকরো? বালাইষাট!
কিছু বইতে মার্কার দেওয়া সুতো থাকে, সে বই আমার খুব পছন্দের। প্রকাশক যেন জানে পাঠকের পক্ষে সবটা বই একবার বসে পড়ে ফেলা সম্ভব না। সময়কে একটা জায়গায় স্থির রাখতে এ সূতো ধ্রুবতারার কাজ করবে। কিন্তু তেমন উদার সহমর্মী প্রকাশকের সংখ্যা নিতান্তই কড়ে গোনা। তাও একহাতের সব কড়-ই কাজে লাগবে না।
ইদানীং অবশ্য কিণ্ডলে বা মোবাইলের ই-রিডারে সে সুবিধাটা আছে। আমি যত বই পড়ি না কেন একসাথে সে মনে রেখে দেয়। কিন্তু তবু কাগজের টুকরো মার্কারের গুরুত্ব আলাদাই। খুব কঠিন বই হলে মার্কার থাকতে থাকতে ধুলোয় ঢেকে যায়। আবার নতুন উদ্যোগে নতুন মার্কার আনি। মনে মনে বলি, বাবা তুই যেন সার্থক হোস, গতবার কিস্যু বুঝিনি এই বইটা পড়তে গিয়ে। কান্ট মহাশয়, স্পিনোজা প্রমুখেরা আমার যে কত মার্কারের অকালপতন দেখেছেন কি আর বলি। যা হোক, অবশেষে ধরা দিয়েছেন সে আমার আর আমার মার্কারের অসীম ভাগ্যি।
এই হল গিয়ে আমার মার্কারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো গুটিকয়েক কথা। মার্কার তবে পাঠকের জীবনের ধ্রুবতারা।