Skip to main content

কেন আসো বুড়ি? কি চাই তোমার? সারাগায়ে রত্তি তো নেই একফোঁটাও। ছেঁড়া ফুটিফাটা শাড়ি। হাওয়াই চটিটার বয়েস তো যেন তোমার চেয়েও বেশি বুড়ি, ওকে রেহাই দাও এবার। তোমার কোলের কাছে লাঠি দেখছি যে বুড়ি, ওই লাঠি ঠুকে ঠুকে আসো বুঝি এই মন্দিরে? গাড়ি চড়ার পয়সা নেই? সে তো দেখেই বুঝেছি। তা কে বেশি শক্ত বুড়ি - তোমার ওই কাঠের লাঠি না তোমার ওই মন্দিরের পাথরের গোবিন্দ? কার জোরে এতটা পথ পাড়ি দিলে বুড়ি? মুখে তোমার হাজার বলিরেখা, তার আড়ালে যে মুখের শ্রী তা এককালে যে অনেক শকুন চিল ডেকে এনেছে সে তো বুঝতেই পারছি বুড়ি। তাড়ালে কি করে? নাকি অনেকবার ছিঁড়ে খেতে দিয়েছো মাংস ওদের। মনে হয় দিয়েছো বুড়ি। মানে দিতে বাধ্য হয়েছো। তোমার চোখে সব বিশ্বাস গেছে গুলিয়ে রক্তমাংসের শরীরগুলোর উপর। তাই ভগবানের দরজায়, সে আর যা করুক ধর্ষণ করতে পারে না, বলো বুড়ি? ধর্ষণ ঠেকাতেও পারে না জানো বুড়ি তোমার ওই নপুংসক ভগবান। তোমার সাথে যখন কথা বলছি, তখন আমেরিকায় একটা বাচ্চা মেয়ে বাসের জন্য রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে বুড়ি। তার ঠাকুমার সাথে কথা বলছে ফোনে। একটু পর কি হবে জানো? একটা লোক আসবে। গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে ওই আট বছরের মেয়েটাকে। ওকে শকুনের মত ছিঁড়ে খাবে, তারপর ওকে ওই দেশের একটা গ্রামে ঝোঁপে ফেলে রেখে যাবে। ভোরের আলো যখন কুয়াশা ভেদ করে ভেজা শিশির মুছে ঘাসে পড়বে, তখন ওর ক্ষতবিক্ষত, আতঙ্কিত, সব বিশ্বাস হারানো মৃত মুখটা সবার চোখে পড়বে।
তুমি ভাবছ গল্প বুড়ি? না গো না। আমি কাগজে পড়লাম যে! আমার ভগবান মারা গেছে বুড়ি। আর এই মন্দিরগুলো সেই ভগবানের মিউজিয়াম করে বানানো। লোকে দেখে বলবে ওরা এককালে নাকি ছিল? মিউজিয়াম কি? যাদুঘর বুড়ি? তুমি গেছো কখনো কলকাতা? নাকি সারাটা জীবন এই আড়ংঘাটাতেই কাটল চিল শকুনের সাথে লড়তে লড়তে।
গেছো? পুরী? কে নিয়ে গিয়েছিল? স্বামী? ভ্যান চালাতো। ভালোবাসত? লজ্জা পাচ্ছ বুড়ি? পাও। এইটুকু লজ্জা পাবে বলেই তো তোমার স্তনদুটোকে এখনো ব্লাউজে আড়াল করে রাখো। ওর এইটুকু মান থাক। না হলে কবে তুমি সব খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে বুড়ি। দাঁড়ায় যেমন অনেকে। স্তন, যোনি আর কোমল একটা উপত্যকায় চিরকালের বাসা বাঁধবে না কেউ, জানে যে! তাই নিজের শরীরের সবটুকু খুলে পর্যটনক্ষেত্র বানায় বুড়ি। লোকে আসে আর যায়।
পর্যটনক্ষেত্র মানে কি? বেড়াবার জায়গা। ওই পুরীর মতন। আচ্ছা বুড়ি তোমার ছেলেমেয়ে নেই? মারা গেছে? রেলে কাটা পড়েছিল স্বামী সমেত? বাহ্‌ বুড়ি। তোমার তো তবে ঝাড়া হাত-পা। কাঁদো না বুড়ি? হাসলে যে! কান্না সব কাঁদা হয়ে গেছে? ওরকম হেসো না বুড়ি, ওই পাথরের মূর্তিও যে লজ্জা পাবে। ওর যে কিছু মান রইল না গো!
রইল ওর মান? কি ভাবে বুড়ি? চুপ করলে কেন? ও চন্দনের ছাপ নেবে? নাও। সেও তো তোমায় ভিক্ষা চেয়ে নিতে হল বুড়ি। কই ওরা এগিয়ে এসে আমাদের সাধল, তোমায় সাধল না যে? আমাদের যে টাকার ভার আছে, মানের ভার আছে, তোমার কি আছে বুড়ি? থাকত যৌবন তো কিছুটা মান পেতে। ছুটে গেলে চন্দনের ছাপ নিতে। দিল কৃপা করে? বাটিটা চেঁছেপুঁছে যেটুকু বাড়তি দিল? না হলে শুকিয়ে নষ্ট হত যে বুড়ি। তাই পেলে ওই পোড়া কপালে। আমি নিলাম না কেন? না আমি নেবো না। জেদ করলে না যে? অভিমান হল, আমি নিলাম না বলে? আমি যে সব ছাপ ছেড়ে দিয়েছি বুড়ি, আমিও গোবিন্দকেই খুঁজছি, তার সাথে ভীষণ ঝগড়া বুড়ি। আমায় বিস্তর ফাঁকি দিয়েছে যে সে! সব বিশ্বাসগুলোয় মাজরাপোকা লেগেছে বুড়ি। ঝুরঝুর করে ঝরে যাচ্ছে সব ফসল বুকের মধ্যে বুড়ি, তুমি দেখতে পাচ্ছো না?
আসি বুড়ি। আমার যে ফিরতে হবে। এই পাঁচশো বছর পুরোনো যুগলকিশোর মন্দির আমায় তোমার দুটো চোখ ফিরিয়ে দিল। বাকি তো সব ভেংচি বুড়ি। মানুষের চালাকি, সব সঙ বুড়ি। রেগো না। এত শান্ত কি করে হলে বুড়ি? হাসছ? আমাদের সব লাভ-ক্ষতির পারে একটা জগৎ আছে না বুড়ি? সেখানে শুধুই ভাবের আনাগোনা, না? শুনেছি আমি। তবে যেতে চাই কিনা বুঝিনি। পায়ে যে বেড়ি পরানো বুড়ি, খুলতে চাই না, ওর আওয়াজেই চলে ফিরে বেড়াই, নূপুরের মত বাজে ওটা আমার পায়ে পায়ে। সব কিছু হারিয়ে ফেলা মুখের ভাব কি আর অভিনয় করে রপ্ত হয় বুড়ি? ওই একটা অভিনয় মানুষ এখনো রপ্ত করতে পারেনি মানুষ। "আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়"... এক পাগলের লেখা বুড়ি। তোমার জিত হল বুড়ি। সব হারিয়ে বেঁচে গেছো, আমি অপেক্ষায় আছি। এ তো জোয়ারের অপেক্ষা না বুড়ি যে ভাঁটার টানে সব ফিরে পাবার আশায় সব ভাসাবো। এ তো বন্যার অপেক্ষা, তোমার মত সব যাক, চিরকালের মত যাক। আমার প্রণাম আর প্রণামী দুই-ই তুমিই নাও বুড়ি, পিলসুজেই প্রদীপের শিখাকে প্রণাম করে গেলাম। যখন প্রদীপ জ্বলবে, আমার হয়ে ওই পাথরকে বোলো, যেন আমাকেও ভাসায়।
আসি বুড়ি। যেতে হবে। শিকলে টান লেগেছে।