Skip to main content


গুটিগুটি পায়ে গিয়ে আবার হাজির ঠাকুরমশায়ের কাছে। তিনি আড়চোখে দেখে কথা বললেন না। জবার মালাগুলো আলাদা করছেন। পুজো শুরু হতে বেশি দেরি নেই। এই হম্বিতম্বি গ্রামে এইটাই সব চাইতে বড় কালীপুজো। লোক হয় মেলা। দু'দিন খাওয়ানো হয়। একদিন খিচুড়ি। পরেরদিন লুচি। কিন্তু নিরামিষ। এই কালীকে অনেকে ওইজন্যে নিরামিষ কালী বলে। বলি বন্ধ প্রায় বছর পঁচিশেক হল। গ্রামের জমিদার হরিকান্ত একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন মা চলে যাচ্ছেন হেঁটে হেঁটে, পিছনে সার দিয়ে পাঁঠার দল। হরিকান্ত কেঁদে মায়ের পায়ে পড়ে বলেছিল, মা তুই কই যাস?

    মা বলেছিলেন, কাশী। দেশ কি তুই পাঁঠাহীন করবি হরিকান্ত?

    ব্যস! সেই থেকে বলি বন্ধ। আর আজকের সমস্যার শুরুও সেখান থেকে। জলদ নস্করের পাঁঠাটা সকাল থেকেই মন্দিরের চারদিকে ঘুরঘুর করছে, আর থেকে থেকেই হাড়িকাঠে মাথাটা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এ-ও ছাড়িয়ে আনতে গেলেই এমন চীৎকার জুড়ছে যে পেট নরম মানুষের কাপড়চোপড় সাদা রাখা দায় অমন ডাক কানে গেলে। 

    তো যা হোক, এই করে প্রায় রাত হল। রতন পাঁঠা আবার মন্দিরের পিছনের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে। খগেন পুরুত তাকিয়েও না তাকানোর ভান করলেন। কিন্তু সে নড়ার নাম নেয় না। থেকে থেকেই করুণ সুরে ডেকে যাচ্ছে, এই যে দাদা, এই দিকে, দাদা এই দিকে…. একটু টুক্ করে নামিয়ে দিন না…. কতক্ষণই বা লাগবে…. একটু দেখুন না…. প্লিজ…

    খগেন, দুত্তেরি, বলে পাশে বসা নাতি হাবুকে মালা আর ফুল বাছতে বলে উঠে গেল। একটা বিড়ি ধরিয়ে মন্দিরের পিছনে পুকুর পাড়ে বাঁধানো ঘাটে বসল। রতন এসে পাশে দাঁড়ালো। খগেন বলল, বোস। রতন সামনের পা দুটো মুড়ে বসল। 

    খগেন বলল, কেন পাগলামি করচিস বাপ, আমাদের গ্রামে কি কচি ঘাস ফুরিয়েচে... মানলাম তোর মালিক জলদের পানদোষটা বেড়েছে, আগের মত যত্নআত্তি করে না, তা বলে বেঘোরে প্রাণটা দিবি?

    রতন মাথাটা আকাশের দিকে তুলে উদাস স্বরে বলল, মায়ের কাছে চলে যাই.. আমার আর বাঁচতে ভালো লাগে না…

    খগেন বলল, একটা বয়সের পর কারোরই আর বাঁচতে ভালো লাগে না…. তা বলে অমন হাড়িকাঠে মাথা গলিয়ে দিবি?

    রতন বলল, আর না তো কি! দুটো ছেলের একটাও মানুষ... থুড়ি ছাগল হল না... তুমি শেষ ওদের কবে এ গ্রামে দেখেছ বলো…. কোথায় যে গেল? কেউ কেটে খেয়ে নিলো কিনা….

    খগেন বলল, দোকানে কথা বলেছিস? নিতাই তো শহরে পাঁঠা বিক্রী করে... কলকাতার বাবুরা খায়….

    জানি। কিন্তু কোলেস্টেরল বেড়ে যাবে বলে ভয়ে ভয়ে খায়... তারপর আবার শুনেছি বিরিয়ানিতেও নাকি দিয়ে দেয়…. শেষে কি ওই ম্লেচ্ছদের রান্নায় গিয়ে….

    রতন ডুকরে উঠল…. খগেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাঁদিস না... আজকাল কি অত জাতপাত দেখলে চলে? তবে তুই যখন চাইছিস না…. তা রেললাইনের দিকে যাস না কেন? ওদিকেও তো চেষ্টা করতে পারিস….

    না ঠাকুরমশায়। আমার শ্বশুরের কথা মনে নেই? সে সামনের দুটো ঠ্যাঙ খুইয়ে কি ভাবে শেষ ক'টাদিন কাটাল! মুখের সামনে ঘাস তুলে দেওয়ার কেউ ছিল না... শেষে পাড়ার ছেলেরা ক্রিসমাসের রাতে পিকনিকে….. রতন দীর্ঘশ্বাস ফেলল…

    খগেন বলল, দেখো দেখি, আমি তো এত ভেবে দেখিনি... কিন্তু আমাদের তো এখানে বলি বন্ধ….

    চালু করলেই হয়... মা-ও খেলেন... তোমরাও প্রসাদ পেলে…. আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, প্রায় আধগ্রাম লোক আমি এখনও খাইয়ে দিতে কি পারি না?

    খগেনের মনটা এমনিতে নরম। এমন আর্তি শুনে চোখে জল এলো তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি... সবাইকে তারাদের মধ্যে দেখতে দেখতে ভাবল, পাঁঠাতেও কি তারা হয়?

    খগেন বলল, যা জেদ ধরিস না রতন। বাড়ি যা। মা যেটুকু পরমায়ু দিয়েছেন আনন্দে কাটা। আমি পুজোয় বসি বুঝলি! 

    রতন খগেনের পায়ের উপর এসে পড়ল। বলল, যে করেই হোক আমার একটা হিল্লে আজ আপনাকে না করে দিলেই নয় পুরুত ঠাকুর। 

    খগেনের হঠাৎ মনে হল, এই কি তবে মায়ের ইচ্ছা? তবে আর সে বাধা দেওয়ার কে?

    সে বলল, বেশ। আমি ঘোষণা করে দিচ্ছি, আজ থেকে এই মন্দিরে বলি চালু। 

    গ্রামের লোকজনের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। প্রাচীনপন্থীরা বলল, তা হয় না। আধুনিকেরা বলল, হয় হয়। তবে বেশিরভাগ প্রাচীনেরাই রতনের নধর দেহটা ভেবে আর নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারল না। 

    বলির জন্য সব সরঞ্জাম প্রস্তুত। লোকে থিকথিক করছে চারদিকে। ঢাক বাজছে। ছেলেরা উত্তুঙ্গ নাচছে। সবাই অপেক্ষা করছে, এদিকে হঠাৎ খবর রটে গেল রতনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ। ওদিকে পুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে মা-কে কথা দেওয়া হয়ে গেছে বলি হবে। তবে, এইবার?

    যাই হোক। পুজো শেষ হল। বলি হল না। রতনকে পাওয়া গেল আরো দশদিন পর। পোস্ট অফিসের পিছনে ঘাস খাচ্ছিল। খগেন গিয়েছিল টাকা জমা দিতে। রতনকে দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। সে এক লাফে তার কাছে গিয়ে, তার ঘেঁটি ধরে বলল, বেয়াদব পাঁঠা। সেদিন অতগুলো মানুষের সামনে আমায় হেনস্থা করলি? কেন? কেন?

    রতন সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কি করছেন, ছাড়ুন না…. পাঁঠার কথায় কি কেউ বিশ্বাস করে পুরুত মশায়... আর যদি বা কেউ করেও... সে তবে কতবড় ইয়ে…. ভাবুন…

    খগেনের মাথাটা আরো গরম হল। কিন্তু কেউ কেউ তাকাচ্ছে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে। এরপর বলবে কি হ্যাংলা পুরুত দেখেছ? কাঁচাই খাবে পাঁঠাটা!

    খগেন ফিরছে। পিছন থেকে রতন বলল, তোমার জবাগাছের ক'টা চারা খেয়েছিলাম বলে তুমি আমায় এমন মার মেরেছিলে আমি তিনদিন দাঁড়াতে পারিনি, মনে আছে? তাই একটু মস্করা করলুম আর কি... বা প্রতিশোধ! জবাফুলের শপথ করে সেদিনই বলেছিলুম, মায়ের সামনেই তোমায় শিক্ষা দেব….