সৌরভ ভট্টাচার্য
15 July 2020
চায়ের গরম ভাঁড়টা হাতের চেটোয় ধরে আনতে আনতে হাতটা পুড়ে যাচ্ছিল মনে হচ্ছে। এখনও দু’টো ফ্লোর উঠতে হবে। যে মানুষটা একটা ভাড়া করা বেডে শুয়ে আছে, সে মারা যাবে কোনো একটা অনির্দিষ্ট মুহূর্তে। তার আশেপাশে যে ক’জন মানুষ আছে, কেউ ভালো নেই। কিন্তু সবাই একসাথে মারা যাবে না। যায়ও না। একটা নির্দিষ্ট সময় আছে সবার মারা যাওয়ার। কেউ জানে না - চিকিৎসক, জ্যোতিষী, কেউ জানে না। একমাত্র ঈশ্বর নাকি জানেন। যাকে কেউ জানে না।
মৃত্যু সাপের মত। বেহুলা জানে। আর জানে অরবিন্দ – সাবিত্রী। মৃত্যু লুকিয়ে থাকে। উপাখ্যান বলে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সুখ কি তবে?
হাতের চেটোর পুড়ে যাওয়াতেও সুখ। ভালোবাসার সুখ। ব্রেস্ট ক্যান্সার। ভালোবাসা বুঝল না স্তন। এত ভালোবাসার স্পর্শ মিথ্যা হল। ভাগ্য জয়ী। ভাগ্য জুয়াড়ি। সে ভালোবাসা বোঝে না। কান্না বোঝে না। হাহাকার বোঝে না। শুধু চতুর দান বোঝে, চাল চালে গোপনে। প্রকাশ্যে চাললেও যেখানে পারত না কেউ।
এখন বিষন্নতা। জীবন মানে মহাভারত। ভাগে ভাগে পর্ব। ভূমিকা পর্ব – সূতিকা গৃহে। তারপর শিক্ষাপর্ব, জ্ঞান না, চাতুরী শিক্ষাপর্ব। সত্যজ্ঞান কোনো প্রতিষ্ঠানের অপেক্ষায় থাকে না। সে শিক্ষানিকেতনে ছাত্র মেলা ভার। তারপর আসে জয় পরাজয়ের পর্ব। ঠকানো পর্ব। ঠকে যাওয়া পর্ব। এখন যেমন বিষন্ন পর্ব।
যে বেডে বসে এই বর্ষাসিক্ত বিকেলে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, সে জানে না জীবন মানে কি। যে আমি চা নিয়ে উঠছি সেও জানি না জীবন মানে কি। যে অপেক্ষা করছে, সে জানে সে মৃত্যুকে বেড়ালের মত হাস্পাতালের মেঝেতে ঘুরে বেড়াতে দেখছে। যে আমি চা নিয়ে উঠছি সে আমি জানি না মৃত্যুর রঙ সাদা না গেরুয়া না ধূসর।
এই যে চা
তোমারটা?
আমি দোকানে খেয়ে এসেছি, দুটো ভাঁড় আনা যায় নাকি একসাথে? (হাসি)
আমাদের জীবনটা কি অসম্পূর্ণ হল তবে?
সুখী ছিলে না তুমি?
ছিলাম... শরীরের কাছে যে মনটা... পুকুরের ভিজে পাড়ের মত স্যাঁতস্যাঁতে... সেই মনের কথা বলছি না... সে আমার শরীরের সাথে সাথে ফুরিয়ে যাবে... যে মনটা বাতাসের মত... যার শরীর নেই... তাকে তুমি ধরে রাখবে?...
সব ফাঁকা হয়ে যাবে যে তখন... সব শূন্য...
ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। সার দিয়ে মানুষ নামছে সিঁড়ি বেয়ে। ক্লান্ত মানুষ। উদ্বিগ্ন মানুষ। মৃত্যু প্রার্থনা করা মানুষ। জীবন প্রার্থনা করা মানুষ।
............... ................ ................. .................. .....................
সুখ কি তবে?
এখন হাস্পাতাল নেই। রোগ নেই। শরীর নেই। তবু সুখ আছে। সমস্ত ভেঙে যাওয়াকে কুড়িয়ে নেওয়ার সুখ। ভালোবাসা অল্প অল্প করে ঈশ্বর হয়ে উঠছে। অদৃশ্য সুগন্ধ। সমস্ত পুড়ে যাওয়া শেষ। সব ছাই উড়ে গেছে। ছাইয়ের দাগ সব মিলিয়ে নিয়ে গেছে কান্না। এখন ভাগ্য বসার ঘরে ঝোলানো টুংটাং শব্দ তোলা ধাতব বিলাস। ভাগ্যের প্রতিশ্রুতিতে সুখ নেই। সুখ মানে আত্মা। আত্মগত সুখ। আত্মা মানে চোখ, প্রতিবিম্ব না। ভাগ্য বোঝে না তা, ভাগ্য ষাঁড়ের মত কৌতুকবোধহীন। সে জানে না তার পায়ের তলায় ফুল দলে যাচ্ছে, না চূর্ণ হচ্ছে পাথর।
সে ষাঁড় জব্দ তবে কার কাছে? বুকের মধ্যে রাখা পাটাতন। সে পাটাতনের কাছে হারে সে ষাঁড়, খেলে বেড়ায়। পাটাতনে বসে দেখি বাগান, একটা কোনো বিশেষ ফুলের ফুটে ওঠা, ঝরে পড়া নয়। পাটাতনে দাঁড়িয়ে দেখি সমুদ্র, কোনো একটা ঢেউয়ের ওঠা, পড়া নয়। আমি ভালো আছি। আমার মধ্যে তুমিও ভালো আছো।
তুমি আছো, এইটাই সব চাইতে বড় কথা। আমার হাতের চেটো পোড়ানো একটা চায়ের কাপেই তুমি আমার, দুই বাহুল্য এখন।