সৌরভ ভট্টাচার্য
16 January 2019
'কমিটমেন্ট' শব্দটা ঈশ্বরের মত পবিত্র, ঈশ্বরের মত অস্তিত্বহীন মানসের কাছে।
মানস, অবিবাহিত, ৪৫, সেলস ম্যানেজার একটা ওষুধ কোম্পানীতে। হাওড়া স্টেশনে বসে, মুম্বাই মেল ধরবে, ভায়া এলাহাবাদ, জব্বলপুর যাবে।
জল আনতে উঠল। ট্রেন লেট করে ছাড়বে। রাত দুটো হবে নাকি। জল এনে আবার সিটে বসল। সামনে ট্রলিটার গায়ে একটা বাচ্চা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। প্ল্যাটফর্ম চাইল্ড। নোংরা গা। মানসের বিরক্ত লাগছে, কিন্তু একজন মহিলা একটু দূরে এদিকে তাকিয়ে। তাকে দেখছে না। যদিও মানসের মনে হয় দেখার মত তাকে এখনও - কিলার লুক। একটা লাল টিশার্ট, আর হাফ প্যান্ট পরা সে। অল্প ভুঁড়ি হচ্ছে। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হাইট। মাথার সামনের দিকটা অল্প টাক পড়া শুরু হয়েছে, হেরিডিটি।
বাচ্চাটাকে তাড়াবে? থাক। তার পাশের বার্থও তো হতে পারে। বা উপরে, বা সাইডে। মানসের আপার, A2, এসি টু টায়ার।
মহিলা হয়ত তিরিশ ছুঁয়েছে। লম্বায় প্রায় তার মত, ফর্সা। একটা তুঁতে শাড়ি পরে, সামনে একটা ট্রলি, বিবাহিতা। সাথে কাউকে দেখছে না। বাচ্চাটা ট্রলিতে এলিয়ে শুয়ে। এরকম কেন করছে? অসম্ভব ইরিটেটিং। ফোন বাজছে, মা। থাক ইচ্ছা করছে না। মেয়েটার আমেজ কেটে যাবে।
কমিটমেন্ট বলে কিছু হয় না। ভীতুর যষ্টি। তা ছাড়া সে কেপেবল, তার মুরোদ আছে পটানোর। তার পুঁজি। লাইফ বলতে একটাই...
এই কথাগুলো পুরোনো। বহুবার এই ভাষায় কথা বলেছে নিজের সাথে। কথা বলেনি, কথা আপনি জন্মেছে। হাতের উপর মোবাইলটা ভিজেছে, হাত ঘামছে। বগল ঘামছে। উত্তেজনা হচ্ছে। বড্ড বেশি তাকাচ্ছে কি? আসলে মোমেন্টটা খুঁজছে। হিটিং মোমেন্ট। একটা সিগন্যাল আসে। ঠিক সময়ে রেসপন্স করতে হয়। আগে কয়েকবার ফলস হয়নি তা নয়।
এবার অধৈর্য লাগছে। সে দু-একবার সিগন্যাল দিয়েছে। নো রেসপন্স। লেসবো নাকি মালটা? উঠে যাবে? একটা অপমানিত বোধ হচ্ছে। মিড লাইফ ক্রাইসিস? হাতটা বেশি ঘামছে? গলার কাছটা দপদপ করছে। উত্তেজনায় হয়। হেরে যাচ্ছে? এটা নিয়ে চারবার ফলস হল। তিন মাসে। শুধু প্রফেশনাল দিয়ে... ম্যারমেড়ে।
বাচ্চাটা কই? ট্রলিটা নোংরা হয়েছে? উঠে দেখবে? থাক, মেয়েটা... কই?
দু'জন কুলি দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মানসের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গা-টা গুলাচ্ছে। ফোনটা বাজছে আবার, মা। এই একটাই অকাজের ফোন আসে। বন্ধু নেই। কমিটমেন্ট মানে ঐশ্বরিক মায়া। বোকাদের ধূর্তামি। ট্রেন এখনো এক ঘন্টা দেরি।
ট্রলির পিছন থেকে পেপারটা বার করল। সামনে শুধু অক্ষরের মেলা। ঝাপসা। মাঝে মাঝে সব কিছু থেকে বড্ড বিচ্ছিন্ন লাগে। বোকাদের পৃথিবী। বোকাদের নিয়ম। ভিখারী বাচ্চাটা কই? একটা দশ টাকা দেবে। ওর হাসিটা দেখবে। আশাতীত পাওয়ার হাসি দেখলে আড্রিনাল রাস হয়। বুকের ভিতর থেকে নিষ্ঠুরভাবে কেউ তারিয়ে তারিয়ে দেখে, নে শালা! নিজেকেও দেখে। পার্ট অফ দ্য গেম। কমিন্টমেন্ট নেই। হার আছে।