Skip to main content

টিপের পাতাটা কই? ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে নেই, ট্রে-টাতে নেই। তবে?

কলেজে যখন পড়ত, কেউ তার স্বপ্ন জিজ্ঞাসা করলে বলত, প্যারিসে যেতে চায়। অথচ সারাটা জীবন গেল পুরী, বেণারস, মথুরা আর বৃন্দাবন। বাবা কলেজের ক্লার্ক ছিলেন। স্বামী রেলে কাজ করে। ছেলে হায়দ্রাবাদে সেটলড্। স্বামী পঙ্গু। সেরিব্রাল অ্যাটাক।

আর খুঁজতে ইচ্ছা করল না। বাড়িতে পুজোপাঠের বালাই কোনোদিন নেই। সন্ধ্যে হলে টিভিটা বন্ধ করে ঝুলবারান্দায় গিয়ে বসে। বিকেলে বসে না। লোকে করুণার চোখে তাকায়। ভালো লাগে না। ছেলের কথা, বরের কথা বলে বলে ক্লান্ত। তার কথা যেন জিজ্ঞাসা করতে নেই।

ঝুলবারান্দায় বসে মোবাইলে প্যারিসের ভিডিও দেখে। একই ভিডিও দেখে দেখে মুখস্থ, তবু। আজ মোবাইল সঙ্গে নেই। নেটপ্যাক শেষ। শম্ভু দোকান খুলবে না ক'দিন। দীঘা গেছে। ছেলেকে বললেই হয়, ইচ্ছা করে না। টিপের শূন্য পাতার মত নিজেকে লাগে। শুধু ব্যবহার হয়ে যাওয়া টিপের দাগগুলো আছে। টিপগুলো নেই।

রাস্তাটা ফাঁকা। প্লেন উড়ে যাচ্ছে একটা। প্যারিস যাচ্ছে যদি ভাবি? আমার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে। আচ্ছা, এত দেশ থাকতে প্যারিসই কেন? তার বর জিজ্ঞাসা করেছে। সে বলেছে, প্যারিসই বা নয় কেন? তার বর তর্ক করে না। ঝগড়া করে না। কাউকে কিছু অভিযোগ করে না। সব ভিতরে রেখে দেয়। দিত। এখন তো শুধু মেঝের মত পড়ে থাকে। সারাদিন সময় মাড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু গোঙানিতে টের পাওয়া যায় বাড়িতে আর কেউ আছে। আর যখন পেটে গ্যাস হয়। তার কাজ শুধু মেঝেটাকে পরিষ্কার রাখা। বাইরেটাই। ভিতরে কি হচ্ছে কে জানে!

চারদিক নিস্তব্ধ। আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। টয়লেটে গিয়ে বসল কমোডের উপর। কাঁদতে ইচ্ছা করছে। না কাঁদলেও হয়। তবু কাঁদলেই বা কি? প্যারিসের রাস্তাঘাটের জন্য কাঁদবে। প্যারিসের আকাশ, গাছপালার জন্য কাঁদবে।

"ফ্রেঞ্চ জানিস, যে প্যারিস যাবি? পরপুরুষের সঙ্গে যখন তখন ওসব করতে পারবি যে প্যারিস যাবি?"

শাশুড়ির বোন বলেছিল। তখন সদ্য বিয়ে। কোন কথা বলা যায় আর যায় না, জানত না তো। কি ঠাট্টাই না হত। বাবা রে বাবা! সব আদিরসাত্মক। এত কিছু থাকতে শুধু প্যারিসের পুরুষকেই কেন আকাঙ্খা করবে? এত অতৃপ্তি কেন ওদের?

তারপর যেদিন শুনল সে পুজো করে না… বাবা রে বাবা.. "রবীন্দ্রনাথ বৌদির সঙ্গে শুতো জানিস?"। তার বি.এ. পাশ ননদ বলেছিল। যেন রবীন্দ্রনাথ বৌদির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে এরা সব বাড়ির এক-একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠত।

এসব কথা কেন যে বারবার মনে পড়ে! কপালে হাত দিল। টিপটা না থাকলে কেমন অস্বস্তি লাগে। একটু হিসি হল। ডায়াবেটিস। ও চাইলেই হয়। কিন্তু বারবার কেন শুধু এই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে? এই ফ্ল্যাটে আসার পর তো কত কিছু ঘটেছে। বাবু তখন ইলেভেনে। তার আগে শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবার। পায়খানা পেলেও হিসাব করতে হত কার পরে লাইন আসবে। এখানে তো কত সুখ ছিল। তবু কেন বারবার ওদের কথা মনে পড়ে! আজ বাড়িটা নেই। ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। সামনের পুকুরটাও।

উঠে বাইরে এলো। টিপ কি শেষ?

একটা ভালো শাড়ি বার করল। আয়নার সামনে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কত প্রতিশ্রুতি নিজের এই শরীর আর মনকে দিয়েছিল। শরীর আর মনও দিয়েছিল তাকে। বলেছিল সব হবে, সবুর কর।

দরজায় তালা দিল। রাস্তায় নামল। ধীরে ধীরে হাঁটছে। কানের কাছে কে বলছে এখনও, রমা সবুর কর… সবুর কর… এ জন্মে না হলেও আশ্চে জন্মে তো হবেই… প্যারিস তো পালিয়ে যাচ্ছে না।

কিন্তু সবাই তো পালিয়ে গেল। তার ছেলে, বর, যে থেকেও নেই, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ --- সবাই। গলার কাছে দলা পাকানো কান্না। টিপের দোকান আরো পাঁচ মিনিট হেঁটে। বাজারে এসে গেছে। চশমাটা খুলে আঁচলে চোখটা মুছল। প্লেন যাচ্ছে একটা। আলো চিকমিক করছে। প্যারিস যাচ্ছে হয় তো। যাক। আপাতত টিপের পাতার দোকান।

টিপের পাতা দে না রে…

ক'টা দেব মাসিমা?

একটাই দে।

একটাই নেবে। টিপের পাতা শূন্য হবে বারবার। আবার আসবে। এইটুকু রাস্তা এখনও বেঁচে তার হাঁটার জন্য। এইটুকুও ফুরিয়ে যাবে? না, তা হতে দেবে না। সব প্লেন তো প্যারিসে যায় না শুধু, ফেরেও তো কিছু তার বাড়ির উপর দিয়ে।