Skip to main content

ছেলেটা সাইকেলটা নিয়ে সরু গলির ভিতরে ঢুকেই গেল। এ গলিটায় আসার কথা ছিল না। গলিটার শেষে গঙ্গা, পাশে ইঁটভাটা। কিন্তু বুকের মধ্যে রাক্ষস ঢুকেছে। দু’হাতে বুকের ভিতরটা খামচে ধরে তাকে নাচাচ্ছে। পাগল হয়ে যাবে এক এক সময় মনে হয়। সাইকেলের হাতলদুটো শক্ত করে চেপে ধরে আছে, যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সোজা গঙ্গায় চালিয়েও ঝাঁপ দিয়ে দিতে পারে। এই এত নরকযন্ত্রণার কারণ কে? না এই ইঁটভাটার একটা মেয়ে– ডিম্পল।

    সোনু সাইকেলটা রাখল। মাস্কটা খুলে পকেটে ঢোকালো। একটা সিগারেট ধরিয়ে গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেল। ডিম্পলকে এক ঝলক দেখে নিয়েছে। মাটি মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যস, মনটা শান্ত। কে বলবে একটু আগে এই মনই এমন মাতালের মত করছিল। যেন সাপে কেটেছে।

    ডিম্পলকে ভাবলেই ওর চোখটাই ভাসে মনের পর্দায়। তাকায় যখন মনে হয় যেন সূঁচ বিঁধােচ্ছে কেউ বুকে। অবশ হয়ে যায় শরীর মন। অথচ কত মেয়েকেই ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাতে ছেড়ে এসেছে সোনু। ডিম্পলের মধ্যে কী দেখল তবে? রোগাটে গড়ন। সরু সরু কঙ্কালের মত হাত আর আঙুলগুলো। কিন্তু চোখ! সোনুকে ওই দু’জোড়া চোখ তাড়া করে বেড়ায়।

    সোনু সিগারেটটা ফেলে সবাই যেখানে কাজ করছে, সেদিকে এগোলো। সোনুকে এখানে সবাই সমীহ করে চলে। সোনুর বাবা এখানকার বাজার কমিটির সেক্রেটারি। ক্ষমতা আর টাকা-পয়সা মোটামুটি দুই-ই বেশ ভালো। অন্য সময়ে হলে সোনু বাবার বুলেটটা নিয়েই আসত। কিন্তু আজ, এই দুপুরে বাবা বুলেট নিয়ে কোথায় যেন গেল। সোনু একটা কালো টি-শার্ট আর জিন্স পরে, হাত দুটো কোমরে রেখে কায়দা করে দাঁড়ালো। এটা করতেই হয়। বিষ্ণু আংকেল তার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুটা দূরে একটা ছাউনির নিচে বসে। বাবার বন্ধু। এরই এই ইঁটভাটা। বিষ্ণু আংকেলকে বাবা বলে দিয়েছেন সোনু এদিকে এলেই খবর দিতে তাকে। বিষ্ণু আংকেল দেবে না। জানে কেন দেবে না। বিষ্ণু আংকেল সোনুকে বোঝে। এই খিদে বিষ্ণু আংকেল বোঝে। মায়ের কাছে শুনেছে বিষ্ণু আংকেলের পরিবারে এই নিয়ে অশান্তি খুব। তবে আরেকটা কারণও আছে। বিষ্ণু আংকেলের একটা মেয়ে আছে, ইনভ্যালিড। মাসে নাকি ওষুধেরই খরচ প্রায় দশ হাজার টাকা। একবার নাকি বিষ্ণু আংকেল মাল খেয়ে ওকে খাল্লাস করে দিতে গিয়েছিল। এমন গলা টিপেছিল মেয়েটা নাকি অজ্ঞান মত হয়ে গিয়েছিল। আন্টি ঘরে এসে পড়ায় বেঁচে গিয়েছিল। সেইদিন থেকেই আন্টি বাপের বাড়ি থাকে মেয়েকে নিয়ে।

    ডিম্পল তাকাচ্ছে না। দেমাক আছে। থাকুক। এই দেমাক তো সোনু নিজেই তৈরি করেছে তোল্লাই দিয়ে দিয়ে। সোনু বাঁ পকেটে হাত দিয়ে কন্ডোমের প্যাকেটটা স্পর্শ করল। বুকের ভিতর শুশুকের মত লাফিয়ে আবার ডুব দিয়ে গেল রাক্ষসটা। এই শেষ করে দেবে সোনুকে। নিজেকে এরকম একটা জায়গায় দেখতে ঘেন্নাও লাগে সোনুর। কিন্তু কী যেন তাকে অবশ করে রেখেছে। ক্লাস এইটের পর আর পড়েনি। এখন বয়স চব্বিশ। কম্পিউটারের দোকান আছে।

    সোনু আড়চোখে একবার বিষ্ণু আংকেলকে দেখল। ফোনে কথা বলছে পায়চারী করতে করতে। তাকে ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাচ্ছে। চাইলেই এদিকে আসতে পারে। আসবে না। ডিম্পলকে দিয়ে আরো কয়েক খেপ মাটি কাটিয়ে ইশারায় ছেড়ে দেবে। কাটুক মাটি। ওর ঘামের গন্ধ আরো পাগল করে তোলে সোনুকে।

    হঠাৎ কাঁধে একটা হাত রাখল কেউ। চট্‌ করে পিছনে ফিরে দেখে একটা মাঝবয়েসী লোক, আগে দেখেনি। মাথায় মেহেন্দি করা। মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে ম ম করে। সোনু এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, "কী চাই?"

    লোকটা বলল, "ডিম্পল আমার ভাইঝি, তুই বিয়ে করবি ওকে?" বলতে বলতে লোকটা সোনুর থুতনিটা চেপে ধরে একটা মোচড় দিল। সোনু আড়চোখে দেখল, বিষ্ণু আংকেল নেই। যারা কাজ করছিল তারা দূরে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। ওদের বাচ্চাগুলো মাঠের অন্যদিকে খেলা করছে, তাদের হইহট্টগোল ভেসে আসছে।

    সোনুর চেহারা লোকটার সঙ্গে এঁটে ওঠার মত না। সে দু-একবার হাতটা ছাড়াতে গিয়েও পারল না। কিন্তু মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। এরপর আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না সেটা সোনু জানে। আর বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে হলুদ আর লাল সালোয়ার কামিজ পরে ডিম্পলও তাকিয়ে আছে তার দিকে।

    সোনু নিজে কিছু বোঝার আগেই, দেখল ওর ডান হাতটা হঠাৎ তীব্র বেগে গিয়ে লোকটার বাঁ গালে পড়ল। সজোরে একটা ঘুঁষি। লোকটা বোকার মত একবার হেসে, টালটা কোনোমতে সামলিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সোনুর গালে প্রচণ্ড জোরে একটা থাপ্পড় কষালো। সোনু ছিটকে মাটিতে পড়ল। ভীষণ ধুলো। সারা মুখ চোখ ধুলোয় ধুলো হয়ে গেল।

    এইবার লোকটার পাশে আরো চার পাঁচজন লোক এসে দাঁড়ালো। সোনু প্রথমে ভেবেছিল যে হয় তো থামাতে আসছে। কিন্তু তারা মুখোমুখি হয়ে যেভাবে দাঁড়াচ্ছে তাদের হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে তারা সমঝোতা চাইছে না। তারা একটা অশান্তি চাইছে।

    সোনু উঠে দাঁড়াতে যাবে একটা লোক এসে সজোরে একটা লাথি মারল সোনুর পেটে। সোনু কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল পুরো। কিছু বোঝার আগেই কয়েকজন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারালো সোনু।

    জ্ঞান ফিরল যখন প্রথমে বুঝতে পারছিল না কোথায় সে। পরে বুঝল, নিজের বাড়িতে। সারা গায়ে হাত পায়ে বিষব্যথা। দুটো দিন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটল। ঘরে মা ছাড়া আর কেউ এলো না। কথা কিছু হল না। ডাক্তার দু’বেলা এসে দেখে যাচ্ছে। বাবা ঘরে আসেনি একবারও। উঠে খেতে পারছে এখন। নিজে থেকে টয়লেটেও যেতে পারছে। তৃতীয় দিন সন্ধেবেলা হঠাৎ ঘরের দরজা ঠেলে সোনুর বাবা ঢুকল।

    "এখন কেমন ফিল করছ?"

    সোনু মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, "ভালো।"

    "তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে। এটা পরে বললেও হত, কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। কই গো, শুনছ?"

    মা ঢুকল ঘরে। সোনুর বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। কী বলবে? তার কি এইডস হয়েছে? অন্য কোনো খারাপ রোগ?

    সোনুর মা এসে খাটে বসল।

    সোনুর বাবা বলল, "তোমায় বিষ্ণুর মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। আমার দোকান তেমন ভালো চলছে না। বিষ্ণু আমাদের অপজিশান পার্টিতে আছে জানোই। মনে হচ্ছে ইলেকশানে ওরাই আবার থাকবে। আমার যেটা বলার সেটা হল, আমি কোনো রিস্ক নেব না। বিষ্ণু বলেছে ওর মেয়েকে তুমি যদি বিয়ে করে নাও তবে সব তোমার। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, ওই রাস্তার মেয়েছেলেগুলো পালিয়ে যাচ্ছে না, কিন্তু নিজের বাবা মা ফ্যামিলির জন্য তোমায় এটা করতেই হবে।"

    সোনু চোখের সামনে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে এখনই। বাবা-মা বেরিয়ে গেলে সোনু মাথাটা বালিশে গুঁজে শুয়ে পড়ল। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না এসব কী হচ্ছে। তবে কি বাবা'ই এটা করালো? কিন্তু কেন? টেনশান তৈরি করার জন্য?

    চারদিন পর ভোটের রেজাল্ট বেরোলো। বাবার আশঙ্কাই ঠিক হল। বাবা মাত্র দেড় বছরের জন্য বাজার কমিটির সেক্রেটারি ছিল। ইস্তফা দিল। পরের দিন খবর এলো বাবার দোকানটা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছে। সোনু রাজি হল।

    সন্ধেবেলা। বাবা বাবার ঘরে। মা টিভি দেখছে। সোনু ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ মনে হল পিঠে যেন কেউ হাত রাখল। সোনু চমকে উঠে দেখে ডিম্পল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সোনু, হঠাৎ দরজা খুলে বিষ্ণু আংকেল ঢুকল। সোনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "শরীর ফিট তো? সরি। রাজনীতি, বুঝলে না। ওসব করতে হয় অল্পস্বল্প। এঞ্জয় ইয়ং ম্যান, তোমার গিফট থাকল আঙ্কেলের তরফ থেকে", বলে ডিম্পলের দিকে ইশারায় তাকালো বিষ্ণু আংকেল, তারপর একটা কন্ডোমের প্যাকেট ছুঁড়ে খাটে ফেলে গেল।

    সোনুর এই প্রথম ভীষণ লজ্জা, সংকোচ সব মিলিয়ে কেমন যেন লাগতে লাগল। এ অনুভূতিটা তার নতুন। ছোটোবেলা থেকে সে যা চেয়েছে তাই পেয়ে এসেছে। চাইলে পাওয়া যায় না, অপেক্ষা করতে হয়― এই শব্দগুলো সোনুর অভিজ্ঞতায় ছিল না। কিন্তু আজ সব কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেল। গা গুলােতে লাগল। ডিম্পল শাড়ি খুলছে। কালো নগ্ন শরীরটা থেকে যেন হঠাৎ ইঁটভাটার গন্ধ নাকে এলো। সোনু ওকে ঠেলে বেরিয়ে ছাদে চলে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাদের এক কোণে বসে থাকল। মাইক চলছে কোনো একটা ক্লাবে। সব কিছু বিরক্ত লাগছে। ভীষণ বিরক্ত লাগছে। অসহ্য। মাথাটা পুরো ফাঁকা লাগছে। কিছুর সঙ্গে কিছু রিলেট করতে পারছে না। ধীরে ধীরে উঠে ছাদের ধারে এলো। ছ’তলার উপর ছাদ। এক ঝলকে যেন দেখতে পেল ডিম্পল, বাবা আর বিষ্ণু আংকেলের সঙ্গে শুয়ে। তার নগ্ন বুকের উপর হাত বোলাচ্ছে বাবা। বিষ্ণু আংকেল পিছন থেকে জড়িয়ে আছে ডিম্পলকে। ডিম্পলের চোখ দুটো তার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে। কিছু বলছে না। শুধু তাকিয়ে। কালী মন্দিরের প্রতিমা যেমন তাকিয়ে থাকে। কিচ্ছু বলে না।

    সন্ধের অন্ধকারে কেউ খেয়াল করল না সোনু ছাদের কার্নিশ টপকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। শুধু হাত দুটো ছেড়ে দেওয়ার অপেক্ষায়। নীচে রাস্তা, বাজারের হাজার মানুষের কোলাহলে ডিম্পলের গোঙানি কেউ টের পাচ্ছিল না। ডিম্পলের নগ্নতা তখন উৎসবের আমেজে, যে নগ্ন শরীরটা গঙ্গার জলে আগামীকাল ভেসে কোথায় চলে যাবে কেউ জানবে না, যখন বাজার বন্ধ থাকবে বাজার কমিটির প্রাক্তন সেক্রেটারির একমাত্র ছেলের আকস্মিক মৃত্যুর শোকে। যখন সবাই আলোচনা করবে যে ভোটের হার সহ্য করতে না পেরে নাকি সে আত্মঘাতী হয়েছে।