Skip to main content

 

ছেলে বলল, মা পুজোয় বন্ধুরা দীঘা যাচ্ছি। ছেলের বাবা বলল, শুনছ, এবার পুজোয় মালিক কাশী নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

দু'জনকেই বলল, যাও যাও। ঘুরে এসো। সারা বছর কাজ তো আছেই। আর পুজোর ক'টা দিন তো আমার মণ্ডপেই কেটে যায়। যাও যাও।

=======

কিন্তু বিঁধে থাকল। যদিও এটাই স্বাভাবিক। নাকি এটাই প্রথা? যা প্রথা, সেটাই কি স্বাভাবিক? প্রথা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। মানুষ ক্রমে সেটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কিন্তু দিন বদলিয়েছে, অন্য সমাজের প্রথার সঙ্গে তুলনা করে দেখেছে যখন, তখন মনে হয়েছে, না তো, এটা তো স্বাভাবিক নয়।

রঞ্জনা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। কিন্তু তার স্বামী এইটের গণ্ডী পেরোয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। কারণ গ্র‍্যাজুয়েশান পড়াতে পারবে না। ছেলে এই গ্র‍্যাজুয়েট হল।

মানুষের সঙ্গে তর্ক করা যায়, প্রথার সঙ্গে তর্ক করা মানে ছায়ার সঙ্গে তর্ক। কিন্তু সেই ছায়ার জুলুম তো কম নয়!

তুলনা করতে না জানলে মানুষের চোখ খোলে না। পড়াশোনা তুলনা করার চোখ খুলে দেয়, যদি সে চায় তো। এই তো ঘরেই গ্র‍্যাজুয়েট ছেলে। চিন্তাভাবনা কই? মোবাইল আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিন কাটছে। বলছে নাকি ব্যবসা করবে কোন বন্ধু সামনের বছর বি-কম পাশ করলেই।

বিশ্বাস হয় না।

=======

প্রথার পর প্রথা। জালের মত। রঞ্জনা নিজের জন্য নিজের কিছু প্রশ্ন সাজিয়েছে। সেগুলোর উত্তর নিজের মত করে খুঁজতে চাইছে। উত্তর খুঁজতে চাইছে না। উত্তরে বিশ্বাস করতে চাইছে। পারবে কী?

এর মধ্যে কলকাতার হাসপাতালের ঘটনা ঘটল। তারপর?

=======

ছেলে বলল, মা পুজোর সময় যাচ্ছি না।

স্বামী বলল, শুনছ, আমি যাচ্ছি না। বলে দিলাম।

রঞ্জনা দু'জনের মুখের দিকে তাকালো। তাদের মুখে এমন নিশ্চিত একটা বিশ্বাস। এরা যা ভাবে, জানে সেটাই নির্ভুল। রঞ্জনা এখানেই একটা নার্সিংহোমে কাজ করে। বিশেষ কিছু না, ওই অফিশিয়াল কাজ কিছু। অল্পস্বল্প কম্পিউটারটা শিখেছে। খবরের কাগজটা মন দিয়ে পড়ে। বাংলাতেই।

কী স্থির বিশ্বাসে ওরা নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। রঞ্জনার এ ক্ষেত্রে কিছু বলার থাকতে পারে এটা দু'জনেরই মাথায় এলো না। তার কারণ?

উত্তরটা সোজা, ওরা রঞ্জনাকে পাহারা দেবে।

মেয়েরা ছেলেদের পাহারায় বাঁচে, এটা প্রথা। প্রথা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সেটাই কী উচিৎ?

=======

রঞ্জনাকে নাইট ডিউটি দেওয়া হয় না। এটা ভাবতেই পারে না। রঞ্জনার এতদিন এটা স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু একদিন এমন কিছু ঘটেছে তার মনেও প্রশ্ন উঠছে, এটাই কী স্বাভাবিক, না এটা প্রথা?

বাড়ির থেকে বেরোনোর সময় যেমন বাড়িতে তালা দিয়ে বেরোতে হয়, মানুষের বিবেক-শিক্ষা-বিবেচনার উপর আস্থা রেখে বেরোনো যায় না, সে যতই আমি মানবতাবাদী হই না কেন, এও তেমন।

রঞ্জনার সোশিওলজি স্যার বলতেন। মেয়েদের এই ক্ষেত্রে প্র‍্যাগমাটিক হওয়া উচিৎ। বাস্তবটা মেনে নিয়ে। সুরক্ষা নিজের সাবধানতায়।

রঞ্জনা বাড়ি ফিরে এ টি দেব-এর ডিক্সনারিতে ‘'প্র‍্যাগম্যাটিক” শব্দটার মানে খুঁজেছিল। তার মাকে বলেছিল স্যারের কথাটা, মা বলেছিল, শুনতে ভালো না লাগলেও এটাই বাস্তব। কাণ্ডজ্ঞান বোধ থাকলে সবাই তাই করবে।

=======

রঞ্জনা রাত্তিরে খেতে বসে বলল, তোমরা কেন থাকতে চাইছ?

স্বামী শুনল না। মোবাইলে নিউজ দেখছে। ছেলে বলল, পুজোর সময় একা থাকবে নাকি? দেখছ না যা হচ্ছে চারদিকে?

রঞ্জনা স্বামীর দিকে তাকালো। কোনো অ্যাক্সিডেন্টের নিউজ দেখাচ্ছে। রঞ্জনা একটু জোরেই বলল, যে যার প্ল্যান অনুযায়ী যাবে। আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য থাকার দরকার নেই।

ছেলে বলল, বাড়াবাড়ি কোরো না।

স্বামী ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু, বাঁকা হাসি। থালাটা বাড়িয়ে বলল, ডাল দাও।

রঞ্জনা ডাল দিল। বলল, যদি না যাস, না যাবি, তবে আমি বুলুদের সঙ্গে পুরী চলে যাব। আমাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল। হ্যাঁ বলে দিই তবে?

=======

সেদিনের পর থেকে কেউ আর যাওয়া নিয়ে কথা বলেনি বাড়িতে। কে কোথায় যাবে সবটাই যেন উহ্য। লুকোচুরি খেলা হচ্ছে যেন।

রঞ্জনার মাথায় এখন একটাই তর্ক ঘোরে, যা প্রথা সেটাই কি ঠিক? স্বাভাবিক তো অবশ্যই। হয় তো কেউ যাবে না কোথাও। রঞ্জনাও যাবে না। পুজোর সময় যেতে ইচ্ছা করে না কোথাও, তাই। আর বাদবাকি সব? ট্রেনে, বাসে চলতে ফিরতে যে ছোটো-ছোটো বিরক্তিগুলো? সেগুলোও তো প্রথা। কিছু অভ্যাস তো প্রথাই হয়ে যায়, সমাজ দেখেও দেখে না। কিম্বা বলে, এ আর এমন কি, এর চাইতেও…..

রঞ্জনা নিজের রাগের দিকে নিজে অসহায়ের মত তাকায়। এত রাগ হত না তো আগে! এখন অল্পেতে এত বিরক্তি জন্মায় কেন? বয়েস হচ্ছে বলে? সেদিন হাসপাতালে একটা অল্পবয়েসি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, তোর অসুবিধা হয় না?

মেয়েটা বলল, রোজ হয় না। আসলে একটা অভ্যাস। ওদেরও, আমাদেরও। আমরা যদি আগে থাকতেই রুখে দাঁড়াতাম, এতদূর গড়াত এত কিছু সব?

=======

রঞ্জনার ঘুম আসছে না। ছেলে-বাবা দু'জনেই হাস্পাতালে, পাড়ার একটা ছেলে সুইসাইড করেছে। প্রেমঘটিত কিছু ছিল।

উঠে বসল, ফোন করল ছেলেকে। ধরল না। স্বামীকে করল, ধরল, বলল সব ঠিক আছে। তুমি শুয়ে পড়ো, আমাদের ফিরতে বেলা হবে।

রঞ্জনার দুশ্চিন্তা হতে শুরু করল। কতরকমের দুশ্চিন্তা। ছেলেকে নিয়ে, স্বামীকে নিয়ে। দুশ্চিন্তা কি এমনই? এত অযৌক্তিক? এত দুর্বল?

মনে মনে ঠিক করল, কাউকে কোথাও যেতে হবে না। দরকার নেই। এত মৃত্যু চারদিকে ভালো লাগছে না। যে ছেলেটা গলায় দড়ি দিল, তাকে কোলে নিয়ে খেলেছে রঞ্জনা। বালিশে মুখ গুঁজে দিল। দলা পাকিয়ে কান্না আসছে গলা ঠেলে। ইচ্ছা করছে এখনই মোবাইলটা নিয়ে জানায়, কাউকে কোত্থাও যেতে হবে না, সবাই একসঙ্গে থাকি। কিম্বা একসঙ্গে যাই। কিন্তু পুজোয় কোথাও যায় না রঞ্জনা। ভালো লাগে না। ইচ্ছা করে না।