Skip to main content
parakiya

সুকৃতিবাবু পেট্রলিং-এর গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করাতে বললেন। মার্চ মাস। রোদ চড়া। হাওয়া ঠাণ্ডা। বেলা সাড়ে দশটা হবে। হঠাৎ হিজলগাছে একটা কোকিল ডেকে উঠল।

সুকৃতিবাবু হাঁ করে তাকালেন গাছটার দিকে। চারদিকে গাছে সবুজ পাতা এসেছে। কিন্তু কোকিলের ডাক! কদ্দিন পর! চোর-ডাকাত, খুন-আত্মহত্যা… কোকিলের ডাক চাপা পড়ে গিয়েছে এ সবের চক্করে কবে!

ছেলেগুলো কাজে লেগে গেছে। হেলমেট চেক করছে। লাইসেন্স দেখছে। দেখুক। আজ ইচ্ছা করছে কোকিলের ডাক শোনার। মন উদাস।

গাড়ি থেকে নেমে একটা বটগাছের তলায় বসলেন। পাশেই হনুমান মন্দির। আজ সোমবার, ভিড় নেই তাই। শনি-মঙ্গলবার উপচে পড়া ভিড়।

ফুলের গন্ধ আসছে। কি ফুল? সব ভুলে গেছেন। আরো মনটা খারাপ হল। কবিতার খাতাটার কথা মনে পড়ল। নিজে লিখতেন না, টুকে রাখতেন ভালো কবিতা।

আবার কোকিলটা ডাকল। ঠিক মাথার উপরে। তাকালেন না। চোখটা বন্ধ করে বসলেন।

একটা ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করল, শরীর খারাপ লাগছে স্যার? লজেন্স এনে দেব? সুগার ফল করছে?

চোখ না খুলেই হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন ওসব কিছু না। ঘাসের উপর পড়া শুকনো পাতার মসমস আওয়াজ শুনে বুঝলেন সুকান্ত চলে গেল।

======

সুকৃতিবাবু চেয়েছিলেন পরকীয়া করবেন। কিন্তু বিয়ে না করলে তো আর পরকীয়া করা যায় না। দু'বার বিয়ে করলেন। সব ভণ্ডুল হল। প্রথমবার ফুলশয্যার রাতে বউ জানালো সে একজনকে ভালোবাসে। ধর্মে মিল নেই বলে জোর করে পুলিশের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। পুলিশ নিয়ে কত ভুল ধারণা মানুষের! ধুস্...! সুকৃতিবাবু নিজে উদ্যোগ নিয়ে তার বিয়ে দিল। কমলিকার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল পারভেজের।

পরের বউ ভীষণ আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। বিয়ের আগে বাড়ির লোক জানায়নি কিছু। সে সপ্তাহে প্রায় চারদিন উপোস করে। মাস ঘুরতেই জানা গেল পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সমাধি হয়। অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগে। গঙ্গাজল লাগে। প্রচুর হ্যাপা। সে সন্ন্যাস নিল অবশেষে। এদিকে সুকৃতিবাবু ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন। মা কালীকে মানেন। সে আলাদা কথা।

কেউ পরকীয়ায় জড়িয়ে অশান্তি করে থানায় এলে তাদের হিংসা হয়। মনে হয় ফাঁসিতে দেন। কিন্তু আইনে বাধে। পরকীয়ায় না জড়ালে কবিতাই কি আর সাহিত্য-সিনেমাই বা কি। সবই তো ওই মূল বিষয়। সে চারুলতাই বলো আর ঘরে বাইরে কি চোখের বালি….. আর আজকাল তো কত 'কীয়া'… শুধু পরকীয়া? জীবনে একটু পরকীয়া হল না বলে কবিতা চলে গেল জীবন থেকে! মানা যায়!

=====

স্যার চা খাবেন?

নিয়ে আয়।

তাকিয়ে দেখেন খোঁচা খোঁচা দাড়ি, রোগা টিঙটিঙে একটা লোক। সুকান্ত ওর কলার ধরে। কিন্তু কলার ধরলে কি হবে, সে লোকের কি অমায়িক হাসি।

বলল, স্যার ঘুমাচ্ছিলেন বুঝি?

সুকৃতিবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, কি করেছে?

সুকান্ত বলল, আজ্ঞে দেখুন না, না আছে হেলমেট, না লাইসেন্স, না গাড়ির কাগজ।

সুকৃতিবাবু রোদচশমাটা পকেট থেকে বার করে চোখে দিলেন। চোখে আজ বড্ড কোমলভাব। এতে আইন রাখা যায় না। কড়া, কোকিল খেদানো গলায় বললেন, গাড়ির কাগজ কই?

সে বলল, চুরির গাড়িতে কি কাগজ থাকে স্যার? ছিঃ!.. এমন লজ্জা দেন না…

সুকৃতিবাবু কিছু বলতে যাবেন, আবার কোকিলটা ডেকে উঠল। উফ্...! জ্বালিয়ে খেলে। কোয়েলিয়া গান থামা এবার… তোর ওই কুহুতান ভালো লাগে না…. বেগম আখতার… আহা কি গলা…! পিলু, না খাম্বাজ? মনে পড়ছে না…. ইস্… শুধু একটা পরকীয়ার না হওয়ার জন্য… কিচ্ছু হল না জীবনে…

======

কেন গাড়ি চুরি করেছিলে?

আজ্ঞে চুমকি চড়তে চাইল…..

বাহ, বেশ বেশ… তা বউকে গাড়ি চড়াবে তো নিজে উপার্জন করে পয়সা জমিয়ে কিনলেই হয়…. কিম্বা ইএমাইতে…

লোকটা জিভ কেটে বলল, ছি ছি স্যার… সব জেনে যে কেন আমায় লজ্জা দিচ্ছেন… আমার বউ তো রাজশ্রী…. এতো আমার…..

পরকীয়া!!!!

রোদ চশমাটা টান মেরে খুলে ফেললেন। এক ঝলকা রোদ খোলা চুলের মত বাণ ডেকে গেল মুখে চোখে। কি আশ্চর্য… কি করা হয়?

আজ্ঞে টুনিলাইটের দোকান….

নাম কি?

আজ্ঞে প্রত্যয়….. প্রত্যয় বসাক….

নিবাস?.... যাক গে… সে চুমকি থাকে কোথায়? সুকান্ত তুমি যাও…. আমি দেখছি…. অ্যাই… এদিকে আয়…. ছাওয়ায় বোস… রোদে দাঁড়িয়ে… এই ল্যাঙপেঙে শরীর… আয় আয়….

=======

সুকান্ত ভুরু কুঁচকে চলে গেল। প্রত্যয় পাশে বসে।

চুমকি প্রত্যয়ের পাশের পাড়ায় থাকে। গোয়ালিনী। রাজশ্রী প্রচণ্ড ধার্মিক। রাতদিন পুজোটুজো করে। ঠাকুরের বই পড়ে। লোককে উপদেশ দেয়। বাচ্চাকাচ্চা নেই। রাজশ্রী চায় না।

সুকৃতিও রাজশ্রীর কথা শুনতে চায় না। চুমকি? ছবি আছে?

এই তো স্যার

এ বাবা…! মোবাইলে… বউ দেখলে?

দেখবে…. আমি শালা কাউকে ভয় খাই না….

বলেই জিভ কেটে সুকৃতির পায়ে প্রণাম করে বলল, আপনাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি তবে… কত লেখাপড়া করে….

আবার কোকিল ডাকল…. পাশে বসে একজন প্রেমিক বিপ্লবী…. চোখে জল আসছে… নিজের জীবন ব্যর্থ… সব ব্যর্থ…কবিতা সাহিত্য… সব ব্যর্থ…

সুকান্ত এসে বলল, কি করবেন স্যার একে?

সুকৃতি বললেন, যাক…. সুকান্ত ছেড়ে দাও আজ একে…. মানুষ একবার ভুল করেছে… করুক… শুধরে যাবে…. ক্ষমা না করলে…..

সুকান্ত বসে পড়ল উবু হয়ে…. বলল, কি হয়েছে স্যার… আপনি এমন কেন করছেন? আপনার মত ভালো মানুষ…..

আর ভালো মানুষ সুকান্ত…. সব কসাই চায় ছাগলগুলো ভালো হোক… মানে কি সুকান্ত…. মানে তারা নিজেরা এসে নিজেদের জবাই হতে সাহায্য করুক…. গোটা সংসার এই কসাই আর ছাগলের গল্প সুকান্ত… কখনও তুমি ছাগল…. অন্য কেউ কসাই…. আবার কখনো তুমি কসাই, অন্য কেউ ছাগল….. সবাই চায় ভালো ছাগল…. সব কসাই চায়… কসাইয়ের কাছে ভালো হয়ে লাভ কি সুকান্ত….

আবার কোকিল ডেকে উঠল। প্রত্যয় চলে গেল। সুকান্ত উবু হয়ে বসে সুকৃতির মুখের দিকে তাকিয়ে। সুকৃতি বলছে, পরকীয়ার মধ্যেই তো প্রেমের বীজ গো…. তোমার আছে?

সুকান্ত বলল, কি যে বলেন স্যার…. আমার তো বিয়েই হয়নি….

সুকৃতি বললেন, কেন গো? বয়েস তো হল….

সুকান্ত বলল, আগে জমাই… কিছুই তো নেই….

সুকৃতি বললেন, কি আর জমাবে গো… দেখো কোকিলের ডাক যেন হারিয়ে না যায়…কবে বিয়ে করবে… কবে পরকীয়া হবে… কবে যে কবিতা বুঝবে…

সুকান্ত সুকৃতির হাত ধরে বলল, বাড়ি চলুন স্যার… আপনার মতিগতি ভালো লাগছে না আমার….

সুকৃতি উদাস হয়ে বললেন, তাই চলো ভাই…. বাড়িই বরং যাই….

কোকিল ডাকল আবার। সুকৃতি গাইছেন…. কোয়েলিয়া মত কর পুকার…..

 

(ছবি: Suman Das)