Skip to main content
খুব রাত হয়েছে তা নয়, দু’দিন হল বৃষ্টিটা থামছেই না, তাই এই রকম লাগছে। এই গ্রামটা বর্ধমান শহর থেকে বাসে লাগে দেড়-দু’ঘন্টা, গোলপাতা গ্রাম। এক সময়ে নাকি গোলপাতা নামে কি একটা গাছে ছেয়েছিল রাস্তাঘাট, পুকুর, দিঘী – সেই থেকেই এই নাম।
       দরজা থেকে মুখটা একবার বাইরে বার করে দেখল অশোক, বৃষ্টিটা থামার নাম নেই, মুখটা গামছা দিয়ে মুছে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ মনে হচ্ছে বাড়ি যাওয়া আর হবে না, বুঝলে?
       উত্তর নেই। সুকুমার পুরোহিত জপে বসেছে। পিলসুজের উপরে রাখা বড় প্রদীপটার কম্পমান শিখায় সুকুমারের কাঁপা কাঁপা ছায়া দেওয়ালে দুলছে। সুকুমারের সামনে বেদীর উপরে মায়ের মূর্তি – এই গ্রামের সবচেয়ে জাগ্রত কালী মন্দির, দক্ষিণাকালী।
       অশোকের বাড়ি না যাওয়ার একটা আছিলা চাই। বউয়ের সাথে বনে না। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও সন্তানহীন। আগে কষ্ট হত। এখন মেনে নিয়েছে। থাকলেও বা কি। এই যে সুকুমার পুরোহিতের অমন কলেজে পড়া ছেলে, সে কিনা পুকুরে ডুবে মরে গেল। এই তো মন্দিরের বাঁ-হাতে একটু এগিয়ে ঘোষেদের বাড়ির পরেই পুকুর। সুকুমার সেই পুকুরের জলই আনে মন্দিরের ঘটে করে। কি হল? সুকুমারের বউটা কয়েক বছর মাথা খারাপের মত কাটালো, তারপর একদিন গলায় দড়ি দিল। বাড়ির সামনের রাস্তার পাশের অশ্বত্থ গাছটায়। সুকুমার কি সেই গাছ কেটেছে? আসতে যেতে তার চোখে পড়ে না? তবে? আসলে কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই। সুকুমার কম লেখাপড়া জানা মানুষ? প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার হলে কি হবে, কলেজের ছাত্রকেও ইংরাজি পড়াতে পারে, এমন বিদ্যে তার আছে। অশোকের নেই। অশোক ম্যাট্রিক ফেল। সে পোস্ট অফিসে কাজ করে। অস্থায়ী কাজ। তবে এটা-ওটা লিখেটিখে দিয়ে কিছু উপরি আয়ও হয়। কিছু জমিটমিও আছে। মোট কথা অভাব নেই।
       ধুপের ছাইয়ের পাশ দিয়ে পিঁপড়ের সারি যাচ্ছে। রাতে তো পিঁপড়ে বেরোয় না। তবে? অশোক হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে পিঁপড়ের সারিকে লক্ষ্য করে এগোলো, অন্ধকারে মিশে গেছে। পকেট থেকে ছোটো মোবাইলটা বার করে হাতের আড়াল করে আবার সারিটার গন্তব্য খোঁজ করল। ওঃ... ওই বাতাসার কৌটোর দিকে যাচ্ছে। মুখটা টাইট করে আঁটা না? আলোটাকে হাতের আড়ালে নিয়ে, যাতে সুকুমারের অসুবিধা না হয়, সেইভাবে কৌটোর কাছে গিয়ে দেখে একটা ফুটো হয়ে আছে।
       কি করছ ওখানে অশোক?
       সুকুমার অশোকের থেকে দশ-বারো বছরের বড় হবে। অশোক দাদা বলেই ডাকে। অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধাও করে। অশোক মোবাইলের আলোটা নিভিয়ে আবার আগের জায়গায় এসে বলল, পিঁপড়ে।  
       সুকুমার বলল, হ্যাঁ, ওটা পাল্টাতে হবে।
       সুকুমার মায়ের সামনে থেকে উঠে এসে অশোকের থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। গুনগুন করে একটা শ্যামাসঙ্গীত গাইছে, “মা যার আনন্দময়ী, সেকি নিরানন্দে থাকে, ইহকালে পরকালে মা তাকে আনন্দে রাখে”।
       সুকুমারের গলায় দরদ আছে। কালীপুজোতে তার গান শুনতে লোকে রাত জাগে। মায়ের পুজো শেষ করে ভোররাতে সে গান গায়। সেই যেন আসল পুজো। চোখের জলে গাল ভেসে যায়।
       “মা কি তোমায় সত্যি আনন্দে রেখেছে দাদা?”
       ফস্ করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল অশোকের। আসলে সে নিজের বউটার কথা ভাবছিল, তাই ভাবনাটা আলগা মন পেয়ে ফস্‌ করে জিভের উপর ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে গেল।
       সুকুমার গান থামালো। অশোকের মুখের দিকে তাকালো। মায়ের মুখের দিকে তাকালো। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে গানটা গাইতে থাকল। অশোকের মনে হল, উফ্..., যাক বাবা, মানুষটাকে কি একটা প্রশ্ন করে বসলাম, এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। আনন্দ যে মা তাকে দেয়নি সেকি আর তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে হবে? কি যেন বুদ্ধি হচ্ছে আমার?
       “তা আনন্দে আমায় রেখেছেন মা, অশোক”
       অশোকের প্রথমে সুকুমারের গলাটা শুনে চমক লাগল। তারপর জেদ চেপে গেল। এই মন্দিরে তো কেউ নেই, তাকে এমন বানানো কথা বলার মানে কি?
       অশোক বলল, সে দেখতেই পাচ্ছি দাদা... কি আনন্দেই মা তোমাকে রেখেছে...
       ব্যঙ্গ করছ অশোক... জানো না বলে এইভাবে ভাবছ... মানুষ আসলে কাকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে জানো অশোক?
       সে যাকে যার ভালো লাগে...
       না, সেটা গৌণ... আসলে নিজেকে...
       সে তো স্বার্থপরতা...
       না, সেটাই জীবধর্ম...
       একটা ভারী কথা বলে দিলেই বুঝি আমি বুঝে যাব... সংসার তোমার চাইতে আমি কম দেখিনি দাদা... তবে বৌদি আত্মহত্যা করল কেন? আমি বলতাম না, তুমিই এমন একটা কথা বললে...
       ভুল তো বলোনি, ব্যাখ্যাটা ভুল করেছ... ও তার পুত্রশোক ভুলতে পারছিল না বলে ওই কাজটি করল... একবার আমার কথা ভাবল? না। সে তার নিজের দিকটাই বড় করে দেখল... তাই হয়...
       এ তো অভিমানের কথা... রাগের কথা...
       সে তুমি ভাবতে পারো... কিন্তু যদি আমার কথা বিশ্বাস করো... তবে জেনো, প্রথম প্রথম কয়েকদিন সে সব লাগলেও এখন আর ওসব ভাব নেই মনে... আমি যে আছি, এই যে পৃথিবীর আলো-বাতাস সব কিছুর মধ্যে আমি হেঁটে ফিরে বেড়াচ্ছি... এইটাই সব চাইতে বড় সুখ... এই থাকাটাই সব চাইতে বড় আনন্দ অশোক... মা কে বলো তো? এই শোক সহ্য করার পাঁচিল। সুখ সহ্য করারও, সবাই বোঝে না।
       বুঝি না, তা না, বুঝি...
       তবেই বোঝো, সমুদ্রের যেমন পাড়, তেমনই মা আমার এই দুঃখ সাগরের পাড়। আমি পাড় হই সে সাধ্য নেই। তবে আমার বুকে ওঠা পাঁজর ভাঙা তোলপাড় করা ঢেউকে এই পাড়ে এসে ফেলতে পারি। মা সেই পাড়। সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানে এই কূলকে হারিয়ে ফেলা অশোক। আমি হারাইনি।
       কিন্তু যার বিশ্বাস হয়নি তোমার মত?
       একি বিশ্বাসের বস্তু? এ তো উপলব্ধির কথা... তুমি যখন পুকুরে স্নানে নামো তখন কি তুমি বিশ্বাস করো তুমি ভিজে যাচ্ছ?
       না
       তেমনই এই সংসারে নেমে একটার পর একটা আঘাতে জর্জরিত হতে হতে মনে হয় না যে এই আঘাতের কোনো পরিণাম নেই তা হতে পারে না, পরিণাম নিশ্চয়ই আছে... মনে হয় না তোমার?
       আমার মাথাটা সারাদিন গুলিয়ে থাকে দাদা, স্পষ্ট করে কিছু বুঝি না...
       তাই হয়... একমাত্র আঘাতই মানুষকে জাগিয়ে রাখে, ঈশ্বর মঙ্গলময় ভুল কথা, ঈশ্বর সাম্যময়। তিনি রাতদিন ব্যালেন্স করে চলেছেন। তাই দেখো না, মায়ের এক হাতে খাঁড়া, আবার একই সাথে বরাভয়।
       বোধ হয় না তো, তিনি ব্যালেন্স করে চলেছেন...
       তুমি যখন রাস্তায় হাঁটো, তোমার বোধ হয় তুমি একটা আদতে গোল ফুটবলের মত পৃথিবীর উপর দিয়ে হাঁটছ? দেখা-শোনা-ভাবা-অনুভবে কি কিছু হয় অশোক...
       তবে কিসে হয়?
       আঘাতে হয়... যন্ত্রণায় হয়... হারালে হয়...
       এই তোমার আনন্দ?
       হ্যাঁ অশোক, এই আমার আনন্দ... আমার সুখ-স্বপ্ন-আশা সব কিছু চলে যাওয়ার পর বুঝলাম, যা গেছে তা আমারই গায়ের ময়লা... এখন যা গায়ে লাগছে তা বাতাস... খোলা বাতাস... আমার আনন্দ...
       অশোক চুপ করে গেল। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সুকুমার চোখ বন্ধ করে বসে। সাড়ে ন’টা বাজে। সুকুমার আজ এই মন্দিরেই থাকবে, কিন্তু সেকি যাবে বাড়ি?
       খিচুড়ি বসাচ্ছি... তুমি কি থাকছ, না যাচ্ছ অশোক?
       অশোক বাড়ি ফিরে দেখে রত্না বিছানা ঝাড়ছে। অশোককে দেখেই জিজ্ঞাসা করল, কি মরতে ফিরলে আজ... আমি তো ভাবলুম... যা হোক আমার কিন্তু খাওয়া হয়ে গেছে... না গিলে এসে থাকলে নিজে কিছু একটা করে গেল... আমার মাথাটা আজ আবার ব্যথা করছে...
       সেই ব্যথাটা?
       হ্যাঁ, তা না তো কি। এতো আমার সাথেই শ্মশানে যাবে...
       রত্না ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা পাখা হাতে অশোক তার মাথার কাছে গিয়ে বসল। তারা দু’জনেই সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। একে অন্যকে দেখলে ঝাঁঝিয়ে উঠছে তাই, যেন দু’জনের ভবিতব্যই জলে ডুবে মরা। কিন্তু পাড় আছে যে... মা... সুকুমারদা বলল... তারা দু’জনে খুঁজলে পাবে না পাড়?
       কি হল? শোওনি? কি করছ?
       হঠাৎ পাশ ফিরতে যেয়ে অশোকের গায়ে ধাক্কা লেগে ঘুম ভেঙে গেছে রত্নার...
       আচ্ছা রত্না, ছেলেপুলে না হলে কি আমাদের সুখী হতে নেই?
       রত্না উঠে বসল খাটে। জানলা দিয়ে মেঘ ছেঁড়া চাঁদের আলো আসছে ঘরে। রত্না চুপ করে বসে। অশোক বলল, মানুষের কত অভাব, কত শোক, কত কষ্ট বলো... আমরা কি আমাদের এই অভাবটা ভুলে সুখে বাঁচতে পারি না? আমায় নিয়ে কি তুমি সুখী নও?
       তুমি কি সুখী আমায় নিয়ে?
       সুখী... কিন্তু কি একটা ক্ষোভে সব পুড়ে যাচ্ছিল রত্না... কেন আমরা নিজেদের জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছি এইভাবে?.. আর না রত্না... আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি... যা হবার না... তা না হোক... যেটুকু আছে সেটুকুকে কেন ক্ষোভের হাতুড়ি পিটিয়ে পিটিয়ে নষ্ট করব আমরা?
       রত্না কান্না চাপা গলায় বলল, জানি না...
       অশোক বলল, আমাদের ভালোবাসায় একটা শরীরের জন্ম দিতে না পারি, কিন্তু একটা মনের জন্ম তো দিতে পারি... যে মনটা সুখী... তৃপ্ত... শিশুর মত... ঈশ্বর যদি ধরাছোঁয়ার বাইরে হয়... আমাদের সন্তানও না হয় সে... আমাদের সুখ... আমাদের আনন্দ... আমাদের মেয়ে...
       অশোকের দু’চোখ জলে ভরে গেল... কতদিন পর তার কান্না পাচ্ছে... তার সামনে দিয়ে যেন মন্দিরের মা মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে... নুপূরের আওয়াজ আসছে কানে... ছম ছম...
       রত্না অশোকের কোলের উপর শুয়ে। অশোক বলল, এই জগন্মাতাই আমাদের মেয়ে আজ থেকে রত্না... আমাদের আনন্দ... আমাদের সুখ... আমাদের সবকিছু...
       রত্না অশোককে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কে শেখালো তোমায় এভাবে ভাবতে গো?... কে...
       অশোক শান্ত গলায় বলল, আমি পাড় পেয়েছি রত্না... মা... তোমাকেও নিয়ে যাব...