Skip to main content


        জনবহুল রাস্তা। আলোয় আলো চারদিক। দুর্গাপূজোর জামা দ্বিতীয় দফায় কালীপূজোতে বেরিয়েছে আবার। কচিকাঁচা, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী-বয়স্করা রাস্তায় --- ঠাকুর দেখতে, প্যাণ্ডেল দেখতে, আলো দেখতে, মানুষ দেখতে।
        মাইকে পান্নালাল, 'চাই না মাগো রাজা হতে'। চোখ পড়ল চায়ের দোকানের পাশে বসা বৃদ্ধ, ময়লা জামা, কুঁজো মানুষটার চশমায়। স্ট্রীট লাইটের দিকে ঘাড়টা উঁচু করে একটা হাঁটুতে হাতের বেড় দিয়ে সেই পা-টা আরেকটা পায়ের উপর তুলে পান্নালালের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছে। কথা মিলছে, সুর মিলছে কিনা জানি না। নাই বা মিলল, প্রাণের সুর যে মিলেছে সে তো সারাটা শরীরই বলছে। চেক চেক জামা, নীলচে প্যান্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। বয়েস হয়ত পঞ্চাশ পেরিয়েছে। 
        একটা বাচ্চা, মা দূরে কথা বলছে, হাত ছাড়িয়েছে অন্যমনস্কতার সুযোগে। সে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো। লাল ফ্রক, ছোট্টো একটা পুতুলের মত লোকটার হাতে হাত রাখল। মানুষটা চমকে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে সম্বিৎ ফিরে এ পাশ, ও পাশ তাকিয়ে দেখল। তার মা কথা বলেই যাচ্ছে, বাচ্চাটা তার মা'কে চেনালো কিনা বলতে পারি না, আমি রাস্তার অন্য ফুটে দাঁড়িয়ে, কিন্তু লোকটা বাচ্চাটার হাত ধরে চায়ের দোকানে গিয়ে একটা বিস্কুট কিনে ওর হাতে দিল। দু'জনেই ফিরে এসে এবার পাশাপাশি বসল। পান্নালালের গলায়, 'আমি সব ছেড়ে মা ধরব তোমার রাঙা চরণদুটি'। যে স্ট্রীট লাইটের দিকে তাকিয়েছিল সেই লাইটে অনেক পোকা। ভদ্রমহিলা হঠাৎ দৌড়ে এলো। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে উত্তেজিত হয়ে, বাচ্চাটা বিস্কুট চিবোতে চিবোতে লোক দেখছে, লোকটা কিছু বলার চেষ্টা করছে, মাইকে পান্নালাল মায়ের চরণ ধরতে চাইছে।

        বাচ্চাটাকে নিয়ে মা চলে গেল। লোকটা তাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর চায়ের দোকানের ভিড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। চায়ের দোকানের আলোগুলোতেও প্রচুর পোকা। চা নিল। একটা ধারে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে আবার সেই বাচ্চাটার চলে যাওয়ার রাস্তায় তাকালো। 
        আমার মনে হল মানুষের হাত, পা, চোখ, নাক, মুখ, বুদ্ধি, যুক্তি'র পারে যদি একটা বেহিসাবি আবেগ আছেই, একজন যুক্তি পারের ঈশ্বরও না হয় থাকুন সেখানে, নইলে ভারসাম্য রাখা ভার। সেখানে মানুষ কিছু না পাক, সেই নিঃশব্দ, নির্জনতায় তার কথা শোনার কেউ একজন আছেন, এ বিশ্বাসটুকু না হয় থাকুক। পান্নালালের ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, একটু শুনো, গান না, স্তব না, আর্তি। একটু মানবিক হও, মানুষেরই তো বুক বলো? অমৃত তো শ্রবণে, তুমিও মানুষের কথা শোনো।