Skip to main content

 

 

 

 

 

উচ্চাঙ্গসংগীত শোনার প্রথা ছিল না বাড়িতে। কি করে হাতে এসে পড়ে মিউজিক টুডে থেকে বেরোনো ভৈরব, উপরে লেখা পণ্ডিত যশরাজ। রেল কলোনির ফাঁকা ফাঁকা মাঠ, বড় বড় গাছের ছায়াঘেরা নির্জন রাস্তা সব বদলে গেল ক্যাসেট প্লেয়ারটা অন হওয়ার খানিকক্ষণ পর থেকেই। ঘরের ভিতর যেন এক ম্যাজিসিয়ান। শুধুমাত্র গলার আওয়াজেই সব রঙ বদলে দিচ্ছে। 
 
       সেই শুরু উচ্চাঙ্গসংগীত শোনার যাত্রা। যশরাজ রাগ শুরু করেন একটা স্তোত্র দিয়ে। মঙ্গলম ভগবান বিষ্ণু, মঙ্গলম গরুঢ়ধ্বজা..... রাগটা যেন একটা কুঁড়ি। ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলবে এইবার। ক্রমে ক্রমে সুর ছবি আঁকবে, মনের নানা অনুভূতির রূপ দিয়ে বলবে, তোমার দুঃখটা এখন এইরকম, তোমার উদাসীনতার ছবি দেখো এইরকম, তোমার বোবা কান্নার রঙ এই, তোমার গভীর বিষাদের ছবিটা এইরকম। বুকটা হাল্কা হবে যশরাজের মীড়ে, গমক তানে, চড়ার স্বরে তীব্র কান্না মেশানো আকুলতায়। আমি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাব। গলে গলে মিশে যাব সেই সুরে। আমার বর্ষা মিঞা মল্লার হবে, নানক মল্লার হবে। আমার বসন্তে বসন্ত বাহার রাগে মৌমাছির গুঞ্জন যশরাজের তানে গুনগুন করবে। গভীর রাতে নায়েকি কানাড়া, দরবারি কানাড়া বিমূর্ত মহাকালের মত আমার সমস্ত সত্তাকে ডেকে বলবে বাইরে এসো। এ সব ম্যাজিক যশরাজ জানেন। মায়ের শেষ কয়েক বছর বারবার মাথার কাছে বেজেছে "ভরত ভাই কপিসে উরিন হাম নাহি", "রাণি তেরো চিরজিও গোপাল"। মায়ের চোখে জল। তখন যশরাজ আর উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী নন। তখন ভক্তিরসের পরম উদগাতা। সকালের সুরে বাজছে "প্রভুজি তুম চন্দন হাম পানি"। মায়ের দৃষ্টি জানলার বাইরে কোথায় হারিয়ে, যেন যশরাজ জানেন সংসারের নোঙর তোলার মন্ত্র। "ওম নমো ভগবতে বাসুদেবায়" গাইতে গাইতে একদম শেষে গিয়ে চূড়ান্ত মুহূর্তে গগনভেদী স্বরে কৃষ্ণনামের সাথে উচ্চারণ হচ্ছে 'আল্লাহ', কি আকুতি, কি আকুল সে ডাক। 
 
       অবশ্যই মন ভারাক্রান্ত। ভীষণ ভারাক্রান্ত। সব ছবিগুলো আছে, শুধু তুলিটা হারিয়ে গেল। কিছু কিছু মানুষের গায়ে এমনভাবে আকাশের রঙ লেগে থাকে, ভুলেই যাই তারাও এ জগতে পরম বিধানের দ্বারা আবদ্ধ। সময় হলে চলে যেতেই হবে। 
 
       আমার আজীবনের ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের নত মস্তক প্রণাম ছাড়া আর কিবা জানানোর আছে। আমার সশ্রদ্ধ, সবিস্ময়, সকৃতজ্ঞ প্রণাম।