সৌরভ ভট্টাচার্য
8 June 2019
অটো নেই। ভর দুপুর। প্রচণ্ড গরম। গোবরডাঙা থেকে আরো বারো কিলোমিটার দূরের কয়েকটা গ্রাম। বাবাই এখানে কয়েকজন হাতুড়ে ডাক্তারকে ভিজিট করতে আসে। আজ ভালোই কাজ হয়েছে। মনটা ফুরফুরে। কিন্তু অটো কই?
চারটে বাইক, তিনটে সাইকেল যাওয়ার পর একটা অটো এলো। বাবাইয়ের ধড়ে প্রাণ এলো। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। গোবরডাঙা স্টেশানের পাশে হোটেলে ভাত খেয়ে ট্রেন ধরবে। পাঁচটার মধ্যে বাড়ি।
অটোতে উঠল। ফাঁকা অটো। স্টেশানের রাস্তাটা খুব সুন্দর। ফাঁকা ফাঁকা। পুকুর। ঝোপঝাড়। বাবাইয়ের চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাটা কাটল। তার দু'পাশে দু'জন মহিলা। সামনে একটা বাচ্চা ছেলে। কখন উঠল? যা হোক, ঘুমের মধ্যেই হবে। বাবাই বাইরে তাকালো। এরকম অচেনা কেন?
দূরে একটা পাহাড়ের মত কি? মেঘ করেছে? অটোটা প্রচণ্ড স্পিডে চলছে। এত জোরে চলে না তো অটো! কিন্তু সামনে ওটা কি? পাহাড় না মেঘ? মনে হচ্ছে পাহাড়।
একটা ঘন ঝোপের সামনে এসে অটোটা দাঁড়িয়ে গেল। মেঘলা চারদিক। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। সামনে পাহাড়টার চুড়োতে হালকা মেঘ জমে। বাবাইয়ের মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে? না তো। মোবাইলটা? পকেট হাতড়ালো, নেই। নীচে পড়েছে? নীচে তাকালো, নেই। তবে? তার পাশে মহিলার শাড়ির আঁচলের নীচে?
অটোটা দাঁড়িয়ে। চারদিক নিস্তব্ধ। এমনকি পাখির আওয়াজ পর্যন্ত নেই। শুধু ঝোপের মধ্যে দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার খসখসে আওয়াজ। কেউ নামছে না। কেউ নড়ছে না। বাবাই ধীরে ধীরে নামার জন্য একজন মহিলাকে এড়িয়ে নামতে যাবে, কাঁধের ব্যাগটা মহিলার কোলে ধাক্কা লাগল। বাবাইয়ের মাথা ঘুরে গেল যা হল দেখে, মহিলার কোমর থেকে ঝুরঝুর করে পড়ে গেল ভেঙে। একটা দমকা হাওয়ায় বাকি সব যাত্রীদের কাপড় জামা উড়ে ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়ল। ভাঙা ভাঙা কঙ্কালের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। দুটো ভাঙা আঙুল বাবাইয়ের গাল খিমচে ধরল। রক্ত বেরোচ্ছে, বাবাই বুঝল।
বাবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ব্যাগটা মাটিতে ফেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এটা কোথায়? কোন জায়গা?
পাহাড়ের মাথায় বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘ করে আসছে। চারদিকে কোনো জনপ্রাণী নেই। ঝোপের মধ্যে থেকে হঠাৎ একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। অটোর সামনে বসে ছিল না? হ্যাঁ তো। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। ন-দশ বছর বয়েস হবে। বাবাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তোমায় ওই পাহাড়ের ওদিকে যেতে হবে। এখানে থাকলে তুমি বাঁচবে না। একটু পরেই সব বাতাস শেষ হয়ে যাবে। জল শুকিয়ে যাবে। দেখছ না কোনো জনপ্রাণী নেই চারদিকে। সব মরে গেছে।
বাবাই চুপ। কি বলবে। ছেলেটা বলল, দেখো, বলে একটা 'ফুঁ' দিল জোরে। সেই ফুঁ'য়ে সব ঝোপঝাড় উড়ে গেল। বাবাই দেখল তার নীচে কঙ্কালের সারি। ছেলেটা বলল, তুমিও মরবে। পালাও।
বাবাই ছেলেটার হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করল। পাহাড়ের চুড়োতে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু জল আসছে কই এদিকে? বাবাই বলল, এদিকে বৃষ্টি হয় না? ছেলেটা বলল, না, দৌড়াও... দৌড়াও... দৌড়াও.....
যত দৌড়াচ্ছে পায়ের পাতা আর সঙ্গ দিচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। বাবাই বলল, জল...
ছেলেটা বলল, নেই....
শ্বাস আটকে আসছে... এরকম কেন হচ্ছে? ছেলেটা বলল, আরো জোরে... আরো জোরে...., বাতাস ফুরিয়ে আসছে....
বাবাই... বাবাই....
বাবাই আর দৌড়াতে পারছে না... কার ডাক যেন কানের কাছে... মা?..... বাবা?.... স্যারেরা?.... চারদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে.... গলা কাঠ... হালকা আলোয় শেষবারের মত বাবাই দেখল চারদিকে লক্ষ লক্ষ পশু, পাখি, মানু্ষের কঙ্কাল..... মোবাইলের পাহাড়... ল্যাপটপ... বড় বড় টাওয়ারের পাহাড়... তার আশেপাশে শুকনো ঘিলু আটকে.... তার মাথার উপর কিছু একটা পড়ল... সব অন্ধকার.......
ব্ল্যাকবোর্ডে চকের দাগ... স্যার পড়াচ্ছেন... পরিবেশ... দূষণ.... মৃত্যু…