শিশির ভেজা ঘাসের উপর ছোটো ছোটো পায়ের ছাপ। শিউলি ছড়ানো এমন, যেন পায়ের ছাপের উপর আলগোছে কেউ রেখে গেছে, অঞ্জলির মত।
দীর্ঘাকৃতি পুরোহিত ফুল তুলতে এসেছিল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সে পায়ের ছাপগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের কোণে জল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে আনল। স্ত্রী হাঁটুগেড়ে বসে সে পায়ের ছাপের দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ গো এ সে-ই, মানুষের পায়ের ছাপ কি এমন ঘাসের উপর পড়ে? কিন্তু সে তো বারো বছর হল, বলো?" পাশেই সেই পুকুর, যে পুকুরের জলে খেলতে খেলতে নেমে গিয়েছিল সে। সেদিন ছিল অষ্টমীর রাত। পুরোহিত ব্যস্ত কালীমন্দিরে, তার স্ত্রী ব্যস্ত রান্নাঘরে, পুজোর ভোগ রাঁধা চলছে, মন্দির চত্বর থিকথিক করছে লোকে। বাঁশের মাথায় হ্যালোজেন বাঁধা এখানে সেখানে। কিন্তু পুকুরের দিকটা ছিল অন্ধকার। কারোর মাথাতেই আসেনি ওদিকে আলো দেওয়ার, যা জঙ্গল ওদিকে কেউ ভাবেনি যে ওদিকে কেউ যেতে পারে। সেই-ই কাল হল, নইলে কারোর না কারোর হয়ত চোখে পড়ত। বাচ্চাটাকে পাওয়া গিয়েছিল ভোরে। পুজোর পোশাকেই।
পুরোহিত আর তার স্ত্রী ঠিক করল সারারাত জেগে বসে থাকবে আজ এই আমলকী গাছটার নীচে।
তাই হল। রাত আটটার পর মন্দির বন্ধ করে দু'জনে এসে বসল গাছের তলায়। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আধখানা চাঁদ শুধু মাথার উপর, তাদের সঙ্গী। দু'জনেই তীব্র উৎকণ্ঠায়। খাওয়ার কথাও মাথায় আসেনি। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি, কিন্তু অন্ধকারে দেখবে কি? একটু গাছের পাতা নড়লেই দু'জনে শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে --- বেড়াল একটা, কখনও কুকুর, তো কখনও শেয়াল। পোকাটার নড়াচড়াও যেন টের পাওয়া যাচ্ছে, এমন উদগ্রীব মন।
পুরোহিত ভাবছে, এক্ষুনি যেন সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে "বাবা" বলে ডেকে উঠবে। তার স্ত্রী ভাবছে কেমন দেখতে হবে মেয়েটাকে এখন? মাঝে মাঝেই জলে ভরে যাচ্ছে দু'জনের চোখ, পরক্ষণেই হতাশা, উদ্বেগ, যদি না আসে!
হঠাৎ পুকুরের দিক থেকে একটা আওয়াজ হল। যেন কেউ পুকুর থেকে নেয়ে উঠল। জলের আওয়াজ, খানিক পরে যেন ঘাসের উপর দিয়ে শুকনো পাতা মাড়িয়ে আসার আওয়াজ। পুরোহিত তার স্ত্রী'র হাতটা চেপে ধরল, মনোরমার হাতটা বরফের মত ঠাণ্ডা। সামনে অন্ধকার ভেদ করে একটা অবয়ব তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, বোঝা যাচ্ছে। চাঁদটা ঢাকা পড়েছে ততক্ষণে কালো মেঘে। মেঘ করে এসেছে কখন দু'জনেই খেয়াল করেনি। তারার আলোটুকুও আসার পথ নেই এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। হঠাৎ হাওয়া শুরু হল জোরে। বিদ্যুৎ চমকে উঠল আকাশের এমাথা ওমাথা তীরের ফলার মত। একটা বিদ্যুতের চমকে এক ঝলকে দু'জনেই দেখল তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একটা। কে? বন্যা কি?
বৃষ্টি শুরু হল। কেউ কোনো কথা বলছে না। মনোরমা পরিতোষের কানে কানে বলল, "একবার ডাকো না।"
পরিতোষ ডাকতে পারল না, অঞ্জলির মন্ত্র বলে উঠল চীৎকার করে, কিন্তু কেন? এ তো মহানিশায় মায়ের পুজোর মন্ত্র! মনোরমা হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল যেন, ভিজে কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে সেই ছায়ামূর্তিটাকে জড়িয়ে ধরতে গেল, কান্নার সাথে মিশে শব্দটা বের হলো... "বন্যা..." মিলিয়ে গেল ঝোড়ো হাওয়ায়...
ঝড় হচ্ছে তুমুল, তার সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। মনোরমা লুটিয়ে মাটিতে। পুরোহিত স্তব গাইছে হাতজোড় করে পাগলের মত, উদভ্রান্তের মত। একটা ছায়ামূর্তি মনোরমার মাথাটার কাছে বসে, স্থির। বিদ্যুৎ চমকালো খুব জোরে আবার। বাজ পড়ল। সামনের নারকেল গাছটা পুড়ে গেল মুহূর্তে। পুরোহিত দেখল সেই আলোর ঝলকানিতে, বন্যা না তো! এ তো কাবেরী!
বিলোচন কাপালিক, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেকার কথা, একদিন রাতে এসে বলল, "আজ আমার সাধনার শেষ দিন। দেখবি চ..."
পরিতোষ তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে, তন্ত্র সাধনায় খুব ঝোঁক। গুরু বিলোচন, পিশাচসিদ্ধ সে। আরো সাধনা নাকি বাকি তার, আজ তা পূর্ণ হবে।
গুরুর পিছনে পিছনে গিয়ে দেখে মন্দিরের পিছনে ভাঁড়ার ঘরের থেকে একটা 'গোঁ গোঁ' শব্দ আসছে। বিলোচন দরজাটার শিকল খুলে ধুতিতে জড়ানো টর্চটা বার করে জ্বেলে ঘরের মধ্যে ফেলল। একটা মেয়ে, ষোলো-সতেরো বছর বয়েস হবে, হাতদুটো পিছন দিকে মোড়ানো, মুখে কাপড় গোঁজা...
পরিতোষ তাকালো না। মেয়েটাকে সে চেনে, পাশের গ্রামের কাবেরী। বাবা নেই। মা চাল ভেজে হাটে নিয়ে আসে। বেচে দিল বিলোচনকে সে? নাকি...
রাত বাড়ল। আরো কয়েকজন কাপালিক এলো। খাঁড়া ধার করা হচ্ছে, তারার আলোয় চকচক করছে তার ধারালো দিকটা। আওয়াজটা গায়ের মধ্যে একটা শিরশিরানি জাগিয়ে যাচ্ছে পরিতোষের।
মাঝরাতে কারণবারি পান করল সবাই। হাটের নকুড়ের মদ। মেয়েটাকেও জোর করে খাওয়াল, নইলে যদি চীৎকার করে। কি বীভৎস উল্লাস। ঝড় উঠেছিল সেদিনও হঠাৎ করেই। বিলোচন চীৎকার করে উঠেছিল "জয় মা!" বলে। তারপর কি নাচ তার! সারা গায়ে-চোখে-মুখে রক্ত ছিটকে এসেছিল পরিতোষের। আর মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিলোচন ফেরার হয়। দু'বছর পর যখন এসেছিল তখন বদ্ধ উন্মাদ। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত, যা পারত তাই খেত। তার কয়েকদিন পর লাইনের ধারে তার কাটা মাথা আর শরীর পাওয়া যায়। সারা পিঠ আঁচড়ের দাগ।
ঝড় বাড়ল। পরিতোষের সারা গায়ে বৃষ্টির জল নয়, যেন রক্ত। আবার বিদ্যুৎ চমকালো। কাবেরীর কোলে মনোরমার মাথাটা রাখা। মনো বেঁচে নেই, পরিতোষ বুঝল। পাশে কে ওটা কাবেরীর হাত ধরে বসে? বন্যা... তবে কি সেদিন রাতে সে-ই ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বন্যাকে? ঝড়ের হাওয়ায় যেন হাসির রোল উঠল... হা... হা... হা....
পরেরদিন সারা গ্রাম যখন মন্দিরের মাঠে ভিড় করে, তখন পুলিশ চলে এসেছে। মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পুরোহিতের স্ত্রী, আমলকী গাছের ডালের উপর পুরোহিতের ধড়টা শুধু, মুন্ডুটা নেই।
এর কয়েক মাস পর পুকুর শুকিয়ে পুরোহিতের মাথাটা পাওয়া যায়, তার নীচেই আরেকটা কঙ্কাল। পরীক্ষা করে জানা যায়, পাশের গ্রামের কাবেরীর, নিখোঁজ ছিল পঁচিশ বছর প্রায়।
সৌরভ ভট্টাচার্য
19 October 2019