সমস্যা ঘোরতর হইল। পাঁচু তর্কালঙ্কারের সাধ ছিল পিতামাতার স্বর্গবাস হইলে গয়ায় গিয়া পিণ্ডদান করিবে, এবং পিতামাতার স্বর্গে সুখে দিনযাপনের একটি পাকাপাকি ব্যবস্থা করিবে।
পাঁচুর পিতামাতার দেহাবসান হইল। কালের নিয়মেই হইল। ঘোরতর নিন্দুকেও কহিল, পাঁচু যা সেবা করিয়াছে পিতামাতার, তাহা এই কলিকালে দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল। গ্রামের সকলে ধন্য ধন্য করিল। পাঁচু শুধু সেবাই করিল না, সেবার নানা মুহূর্ত ইনস্টাগ্রামে বাঁধাইয়া রাখিল। যাহাতে পরপারে গিয়াও সে সকল চিত্র দেখিয়া পিতামাতা সুখী হইতে পারে।
পাঁচুর দৃঢ় বিশ্বাস ইনস্টাগ্রাম ও আমেরিকার যদি সংযোগ রহিয়াছে, তবে স্বর্গেরও সংযোগ রহিয়াছে। কারণ আমেরিকাই স্বর্গ, যাহা সব দেশ লইয়া কাজ করে। যেমন একটি আইফোন বানাইতে যে ১৬০০ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্রব্য লাগিয়া থাকে, তাহা আমেরিকা প্রায় ৪৫ দেশের ২০০টি কারখানা হইতে আনাইয়া থাকে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হইল, আইফোন একটি আন্তর্জাতিক চলমান দূরভাষ শুধু নহে, ইহা একটি বহুজাতিক চলমান দূরভাষ। ইহলোক ও পরলোকের মধ্যে যদি কেহ সংযোগ ঘটাইতে পারে, তবে উহা আইফোন ভিন্ন আর কেহ নহে। পাঁচু তাই আইফোন ভিন্ন ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের কথা ভাবিতেই পারে না।
পাঁচু পিণ্ডি দিল, এবং কল্পচক্ষে দেখিল, অবশ্যই পাণ্ডার উল্লাস দেখিতে সাহায্যও করিল, পিতামাতার প্রেতাত্মা আসিয়া পরে পিণ্ডি ভক্ষণ করিয়া গেল। পাঁচু স্টেটাস দিল, ফিলিং এক্সাইটেড।
ইহার পর পাঁচু ঠিক করিল বুদ্ধগয়া যখন মাত্র আধঘন্টার সড়ক পথের যাত্রা, তাহাও দেখিয়া আইসে। পাঁচু ত্রিচক্রযানে চড়িল। এবং আমাদের আখ্যানের চূড়ান্ত মুহূর্তের সূচনা হইল।
পাঁচু বুদ্ধের সামনে গিয়ে শুনিল, আত্মা বলিয়া কিছু হয় না। মাত্র পনেরো কিলোমিটারের ব্যবধানে আত্মা শূন্য হইয়া যায় কি করিয়া? পাঁচু মাথায় হাত দিয়া পথে বসিয়া পড়িল। হে প্রভু? সবই ভ্রম তবে?
পাঁচু বিচার করিতে বসিল। তাহার গুরু স্টিভ জোবস, আইফোনের যিনি পিতামাতা, তিনি ভারতে আসিয়া পরমগুরু নিমকরালীবাবার কাছে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। নিমকরালীবাবা যখন রামজীর সাধক ছিলেন, তখন নিশ্চয়ই স্টিভ জোবস আত্মায় বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু স্টিভ জোবস…. কিন্তু…
মন কিন্তুতে আছাড় খাইলে কি আর শান্তি পায়….
হঠাৎ পশ্চাদদেশে একটি প্রবল আঘাত পাইয়া পাঁচু মুখ থুবড়াইয়া রাস্তায় পড়িল। নিজেকে কোনোক্রমে তুলিয়া, আবার সাম্যাবস্থায় ফিরিয়া দেখিল একজন ভিখারি মিটমিট করিয়া তাহার দিকে চাহিয়া হাসিতেছে। পাঁচু মনে আঘাত পাইয়াছে বিস্তর, কিন্তু পশ্চাদদেশে আঘাত এই প্রথম। ইহাতে বেদনার অধিক অপমান বোধ হইতে লাগিল। পাঁচু মুখ কাচুমাচু করিয়া শুধাইল, আপনি মারিলেন কেন?
ভিখারি কহিল, পশ্চাদদেশ আছে ইহা লইয়া সংশয় আছে?
পাঁচু কহিল, না।
ভিখারি পাঁচুর দুই গালে দুটি চড় কষাইয়া কহিল... গাল?
পাঁচু কাঁদিয়া কহিল, আছে, আছে বিলক্ষণ আছে।
ভিখারি আর কয়েকটি অঙ্গের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একই প্রকারে পাঁচুকে উপলব্ধি করাইয়া কহিল... তবে আত্মা আত্মা করিয়া মরিতেছ কেন?
পাঁচু কহিল, আজ্ঞে, আমি ক্ষণিক পূর্বে, মাত্র পনেরো কিলোমিটার গতে আত্মাকে আছে বলিয়া জানিলাম, আর এক্ষণে কি শুনিতেছি?.... সব ভ্রম?, সব অনাত্মা….
ভিখারি কহিল, তোমাদিগের অধুনা ভাষায়, তুমি একটি মূর্খসঙ্গমকারী….
পাঁচু হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল... ইহা একটি অত্যন্ত নিকৃষ্ট ভাষা, অশালীন গালাগালি…
ভিখারি কহিল, যে শব্দ পরম পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র উজ্বল করিয়া রহিয়াছে, তাহাকে তোমরা এতাদৃশ অশালীন ভাষায় নামাইয়া আনিয়াছ…. এত অধঃপতন তোমাদিগের... ইহার চাইতে আতঙ্কবাদী হইলে কম দুঃখ পাইতাম….
পাঁচু কহিল, মহাশয়…
ভিখারি বাধা দিয়া কহিল, মহাশয় নহে... ভিক্ষাশয়... অথবা ক্ষুদ্রাশয়….
পাঁচু নিজেকে সংশোধন করিয়া বলিল, বেশ, আপনি এই পবিত্র স্থানে দাঁড়াইয়া এরূপ অশালীন অপবিত্র ভাষা উচ্চারণ করিবেন না…. পাপ হইবে…
ভিখারি কহিল, কাহার? মরিলেই তো সব ফুরাইবে…. আমি কি আত্মায় বিশ্বাসী... আমি কিছুতেই বিশ্বাসী নহি... আমি কেবল আমিই... আমি এটুকুই বলিতে চাহিতেছি তোমাদের বড়ই অধঃপতন হইতেছে দিনে দিনে…. শুদ্ধ শব্দ শুদ্ধ চিত্ত না হইলে কি আর জন্মে? অশুদ্ধ চিত্তে শুদ্ধ ভাষণ তো কপটতারই নামান্তর মাত্র... ইহা তো মানো?
পাঁচু কহিল, মানি….
ভিখারি কহিল, তোমরা আজকাল দেখি গালাগাল, অশালীন, অপবিত্র শব্দ ব্যতীত কথা কহিতে পারো না... আচমন করিতে হয় শুদ্ধতার সহিত করো.. শুদ্ধ জলেই মানুষ আপনাকে শুদ্ধ করে, পাঁকে আচমন করো কেন?
পাঁচু অভিমান করিয়া কহিল, আমি করি না। যাহারা করে তাহারা অন্য মানুষ।
ভিখারি কহিল, বাধা দিয়াছ কি? প্রতিবাদ করিয়াছ কি? করো নাই। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে… স্মরণ করাইবার দরকার আছে কি?
পাঁচু বলিল, তাহা বটে... কিন্তু আত্মা…. উহা কি রহিয়াছে…
ভিখারি কহিল, যাহাই ব্যথা দেয় তাহাই রহিয়াছে…. প্রাণে যদি ব্যথা রহিয়াছে তবে আত্মাও রহিয়াছে…. আত্মার আর এক নাম ব্যথা... বুদ্ধ তাহাকেই সত্য বলিয়াছেন…. যাহার ব্যথা নাই তাহার আত্মাও নাই, অনাত্মাও নাই….
পাঁচু উত্তেজিত হইয়া পড়িল এরূপ ব্যাখ্যা শুনিয়া। শীঘ্র আইফোন বাহির করিল। একটি সেল্ফি তুলিতেই হইবে…. সেল্ফি উঠিল, কিন্তু ভিখারিকে দেখা যাইল না... কেবল মাত্র পাঁচু দন্ত বিকশিত করিয়া হাসিতেছে….
মাথায় কেহ গাঁট্টা মারিল। আবার ভিখারিটিই মারিল। পাঁচু কহিল, মস্তক আছে... বলিয়াছি তো…
ভিখারি কহিল, উহার ব্যবহার শুরু করো….
এই বলিয়া ভিখারি ভিড়ে মিলাইয়া গেল। পাঁচু আবার ত্রিচক্রযানে চড়িয়া গয়ার দিকে আসিতে লাগিল। তাহার মনে সংশয় নাই আর। নিতম্ব জুড়িয়া কিঞ্চিৎ বেদনা হইতেছে, উপশম হইয়া যাইবে। সংসারে সবই যদি অনিত্য, নিতম্বই যদি অনিত্য হইল, তবে তাহার বেদনা লইয়া এত ভাবনা কিসের। পাঁচু দার্শনিকের মত হাসিল।
(ছবি - Suman Das)