পয়সাকড়ি নেই, মেয়েমানুষ পাবো কোত্থেকে?
কথাটা সত্যি নয়। সনাতন পুরোহিতের কথায় নেশা আছে। আজ অবধি কত মেয়েমানুষের সঙ্গ করেছে সে নিজেও গুনে বলতে পারবে না। সনাতন পুরোহিতের বয়েস ছাপান্ন। এক ছেলে অম্বর, এম. এ. পাস করেছে। সংসারে সচ্ছলতা নেই ঠিক, কিন্তু শান্তি আছে। অণিমা সব জানে। মাথা ঘামায় না।
অণিমা নিজেকে আবিষ্কার করে পুকুরপাড়ে আসে যখন। মেয়েদের অর্ধনগ্ন শরীরে অণিমার চোখ বসে ভ্রমরের মত। অণিমার শ্বাস দ্রুত হয়। বুকের মধ্যে ঢেকি কোটে। অণিমা শান্ত হয়ে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। পা দুলায়। জলে ঢেউ ওঠে। অণিমা অপেক্ষা করে রীতার।
রীতার চোখে অণিমা পড়েছিল গোপনে রাখা অণিমাকে। রীতাও বুঝেছিল। গ্রীষ্মের দুপুরে, যখন সনাতন আর অম্বর বাড়ি থাকে না, রীতা এসেছিল। অণিমার মনে হচ্ছিল তাকে ভূতে পেয়েছে। তার মন-শরীর এত অবাধ্য সনাতনের কাছে হয়নি। সেখানে সে বাধ্য। রীতার কাছে অণিমা চাইল আস্কারা। রীতা দিল। অণিমা ভেসে গেল। রীতাও ভাসল, ততটা সুখে নয়, যতটা কৌতুহলে। রীতা অণিমার চাইতে বছর তেরো ছোটো ছিল। দাদারা বিয়ে দেওয়ার সময় করে উঠতে পারেনি। নিজেরা সংসার করে, খাটালে সাতটা গরু আর চারটে মোষ সামলাবে না বউদের সামলাবে? এ কথা দাদারা রাতদিন রীতার কাছে বলে। রীতাই খাটাল সামলায়।
সনাতন বোঝে। বলে না কিছু। বরং এই আছিলায় নিজেকে আরো আস্কারা দিয়ে বাড়িয়ে নেয়। তার সম্ভোগ তৃষ্ণা এখন বিকার। মানু্ষ স্বভাবের সীমা ছাড়িয়ে যখন প্রবৃত্তির দাস হয় তখন সে আর মানুষ থাকে না। সনাতনও মানুষ নেই এখন। সনাতন শিকারী। যজমানদের বাড়িতে এমন কোনো মহিলা নেই যাকে সনাতনের চোখ, মন উলঙ্গ করে দেখেনি। লোকে বলে সনাতনের দৃষ্টি খারাপ। সনাতন বলে, খারাপ না, সৎ। তোদের পেটে খিদে মুখে লাজ। আমার সারা শরীর জুড়ে খিদে।
….. …….. …….. …..
আমাদের গল্পের পটভূমিকা হল এই। আর যে গল্পটা বলব তার সূত্রপাত হল নবমীর দিন। সনাতন শিলিগুড়ি গেছে দূর্গাপুজো করতে। ফি বছর যায়। অম্বর গেছে মামাবাড়ি, তারকেশ্বর। অণিমা গেল না বাপের বাড়ি, কারণ রীতার দাদারা পুরী গেছে ষষ্ঠীর দিন। ওর বড়দার কি একটা মানত আছে জগন্নাথদেবের কাছে। এ সুযোগ সারা জীবনে আর আসবে কিনা জানে না অণিমা, আজ তাই পুকুরঘাটে এত উতলা হয়ে বসে। রীতা এলে আজ এখান থেকেই তার বাড়ি যাবে। আজ আর কাল তার সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু এত দেরি করছে কেন রীতা?
রীতা এলো। আজ পুকুরঘাটে লোক কম। পুজোর মণ্ডপে সব। অণিমা নাস্তিক। তার ভাষায় ঈশ্বর কথা বলতে জানে না। ঈশ্বর তার আত্মার কথা শোনে, শরীরের ভাষা বোঝে না। শরীর ছাড়া আত্মা কি? ভূত। অপবিত্র। নইলে মানুষ মরলে গোবর ছড়ায় কেন? জ্যান্ত মানুষ ঘরে ঢুকলে তো গোবর ছড়ায় না? সনাতন বলে আত্মা ছাড়া শরীর অপবিত্র। তাই ওই ব্যবস্থা। অণিমা বলে শরীর ছাড়া আত্মাকে মানুষ ভয় পায়, পিণ্ডি দেয়, সেকি পবিত্রতা ছড়াবে বলে? সনাতন চুপ করে যায়। তার্কিক অণিমাকে তার ভয় লাগে। বড্ড কর্কশ।
রীতা আসে শরীরের জন্য নয়। একাকীত্বের গোয়াল ঘর থেকে ছাড়া পাবে বলে। অণিমার সোহাগ তার ভালো লাগে। সুখ পায়। কিন্তু মনকে খাদের দিকে ঠেলে দেয় বেশি। সেই খাদের অন্ধকারে তলিয়ে এক পুরুষ। যে জন্মমৃত। যাকে পেল না রীতা। এক-এক সময় মনে হয় গোয়াল ঘরের বাঁশের সঙ্গেই কাপড় জড়িয়ে ঝুলে পড়ে। পারে না। মায়া হয়। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। তার শরীরের গড়ন পুরুষকে টানে। রীতা জানে। কিন্তু সে চোখে খিদে আছে, বায়না নেই। রীতা প্রথম বায়না দেখেছিল অণিমার চোখে। অণিমা তাকে আদর করছে এখন। রীতা চোখ বন্ধ করে অণিমার জিভে, হাতে একজন পুরুষের স্পর্শ খুঁজছে। যে ওই অন্ধকার খাদের থেকে উঠে এসে তার এই নগ্নতাকে ভরিয়ে দেবে সোহাগে। রাত কত? জানে না। দূরে পুজোর ঢাক বাজছে। কাল দশমী। অণিমার জিভের পানের স্বাদ তার জিভকে স্পর্শ করছে। রীতার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা গলায় দড়ি দিয়েছিল। মাথায় ক্যান্সার হয়েছিল। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারত না। রীতা বাবাকে দেখেনি। বাবার আদরের গরুটাকে দেখেছে, শ্যামলী। বাবার কথা ভাবলেই শ্যামলীর গায়ের গন্ধ নাকে আসে।
হঠাৎ দরজায় তুমুল ধাক্কা। ধড়মড় করে উঠল দু'জনে। রাতের অন্ধকারে নিজেদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে পারছে দু'জনেই ভয় পেয়েছে। কি হল? এত রাতে কে?
কোনো রকমে কাপড়টা জড়িয়ে দু'জনেই দরজাটা খুলল। দরজা খুলতেই রীতার বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে। মাথাটা এক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল। পুকুরের ওই পাড়ে তাদের বাড়ি। দাউদাউ করে জ্বলছে খাটালটা।
রীতা আলুথালু বেশেই দৌড়ালো। অণিমা নারকেল গাছের মত স্থির দাঁড়িয়ে রইল দরজার একটা পাল্লা ধরে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল অনেকের চোখে অসভ্য হাসি। যেন তারা জানে। অণিমা দরজা বন্ধ করে দিল মুখের উপর সবার।
….. …….. …….. …..
দু'দিন গেল, অণিমা ঘর থেকে বেরোলো না। বাইরের দরজার গায়ে একটা ফুটো ছিল। ঘুণপোকায় কেটে করেছিল। অণিমা সারাদিন সেই দরজার ফুটোয় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। রীতাকে দেখতে পায় না। কানে যা এসেছে, শুনেছে দুটো গরু নাকি মরেছে, কেউ বলে সবক'টাই নাকি মরেছে। অণিমা জানতে চায় না সে সব, রীতা কই? তার কথা কেউ বলছে না। গরুর কথা, মোষের কথাই হয়ে যাচ্ছে।
দু'দিনের দিন রাত একটা নাগাদ অণিমা ঠিক করল সে এই রাতের অন্ধকারেই যাবে। একাই যাবে। দু'দিন খাওয়া নেই ঘুম নেই, মাথাটা টলছে। বাইরের দরজাটা খুলে এসে দাঁড়ালো। মাথার উপরে আসন্ন কোজাগরীর চাঁদ। অণিমা রাস্তায় হাঁটছে। আচ্ছন্ন অণিমা যখন দাঁড়ালো, সে রীতার বাড়ির সামনে না, দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলের সামনে। মাটির প্রদীপ জ্বলছে। সেই শিখার চঞ্চলতায় অণিমার ঘোর কাটল। এখানে কেন সে?
অণিমা আর নড়ল না। দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে প্রদীপের সামনে। আজ প্রথম মনে হচ্ছে ঈশ্বর বিচার করেন না, আশ্রয় দেন। অণিমার বুকফাটা কান্না পেল। রীতার জন্য না, নিজের জন্য। যে সুখ জন্মের মত হারিয়ে গেল তার জন্যে। যে লালসা তাকে বিবশ করেছে তার জন্য। অণিমা প্যাণ্ডেলের উপর শুয়ে। মাথার উপর ছেঁড়া তিরপলের মধ্যে দিয়ে ফাটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার কাঁধে। অণিমার দু'দিনের সব ক্লান্তি যেন উজাড় করে চোখে নামল। অণিমা ঘুমালো।
….. …….. …….. …..
ঘুম ভাঙল পারুলের ছোঁয়ায়। "ও দিদি... দিদি... ও দিদি…."
অণিমা চমকে উঠল। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল পারুলের মুখের দিকে। পারুল এই গ্রামে বিয়ে হয়ে এসেছে এক বছর হয় নি। কৃষ্ণনগর সদরে বাড়ি। কলেজ পাস। এই মেয়েটাকে সমীহ করে চলে অণিমা। ওরাও ব্রাহ্মণ।
পারুল বলল, তুমি ঘরে যাও... লোকে এইভাবে দেখলে কি বলবে... এমনিতেই….
অণিমা বাকি কথাটা আন্দাজ করে উঠে পড়েই হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ পিছন থেকে ডেকে পারুল বলল, রীতাদিকে পাওয়া যাচ্ছে না জানো…..
অণিমার মাথার ভিতরটা দপ্ করে জ্বলে উঠল। শ্বাস বুকের কাছে এসে আটকে থাকল। পা নড়ছে না। তবু জোর করে নিজেকে টেনে বাড়ি তো আনতেই হবে। পারুলের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলেই পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। পারুল কি সব বলে যাচ্ছে, গরু-মোষ.. পুড়ে কালো ছাই…. শুনতে ইচ্ছা করছে না। মাথাটা পাথরের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অন্ধকার লাগছে মাঝে মাঝেই। বাড়ি ঢুকেই উঠানে শুয়ে পড়ল অণিমা।
একদিন পর সনাতন ফিরছে। কৃষ্ণনগর স্টেশানেই বিজু মাষ্টারের সঙ্গে দেখা। আদ্যোপান্ত সবটাই শুনিয়ে দিল সনাতনকে সে। সনাতন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। এখানকার সব রিকশাওয়ালাই চেনে মোটামুটি সনাতনকে। রিকশাওয়ালাও একই গল্প রং চড়িয়ে বলতে শুরু করল। সনাতন নির্বিকার। এ তারই পাপের শাস্তি। নইলে এত বছর পুজো করছে সে আজ অবধি তো আরতি করতে গিয়ে দুর্গার শাড়িতে আগুন লাগেনি। তবে এবারেই কেন? রিকশাওয়ালা বলে যাচ্ছ, একটা গরুই পুড়েছে মারাত্মক, বাঁচেনি। বাকিগুলো পাড়ার ছেলেরাই খুলে দিয়ে বাঁচিয়েছে। তবে রীতাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। পাশের ঝুনু বুড়িকে দায় ঠেকিয়ে সে পালিয়েছে। এক বুড়ি ওই অতগুলো গোরু-মোষ সামলাতে পারে। কিন্তু না খাইয়েও তো মারতে পারে না। অবশ্য দুধও নাকি হচ্ছে মেলা। বুড়ি সব একা বেচছে নাকি বাজারে। কেউ কিছু বললেই বলছে, আরে ওরা এলেই আমি সব হিসাব দিয়ে দেব। সব পাই পাই হিসাব রাখা আছে আমার। সবাই জানে এ ডাহা মিথ্যাকথা।
রিকশা বেশি এগোতে পারল না। সনাতনের বাড়ির সামনে ভিড়। তার রিকশা দেখতে পেয়েই ঝুনুদি এগিয়ে এসে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, কি সব্বোনাশ করে ফেলল ঠাকুর তোমার বউ…. তাই বলি দু'দিন ঘর থেকে বেরোয় না কেন... আমাদের পারুল জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে সে ঝুলছে গো…. ওরা পুলিশ ডাকতে পাঠিয়েছে... এই এলো বলে…..
ঝুনুর শুকনো কান্না আর জড়ানো কথাগুলো শুনতে শুনতে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালো। পাড়ার ছেলেরা দড়ি কেটে নামিয়ে উঠানে শুইয়েছে অণিমাকে। সনাতন সব জিনিসগুলো দাওয়ায় রেখে কুয়োর পাড়ে গেল, হাত-মুখ ধুতে। এক কাপ চা হলে ভালো হত, কিন্তু চাইতে সাহস হল না।
রীতা ফিরল কালীপুজোর আগের দিন। শ্যামনগরে পিসির বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিল। দাদারা যতটা রাগার কথা রাগেনি, কারণ এ হওয়ারই ছিল। ছোটো ভাইয়ের বউ, জন্ম বাঁজা মেয়েছেলে, এত নোলা, জগন্নাথধামে গিয়ে লুকিয়ে মাংস গিলে মরেছে, তাও মুরগীর, তাদের বংশ যেখানে সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। স্পর্ধা! আর বাচ্চা হবে কোনোদিন! তাও তো একটা গরুর উপর দিয়ে গেছে, পুরো বংশটাই যে উজাড় হয়ে যায়নি এই জগন্নাথ প্রভুর অশেষ কৃপা!