শীতটা জাঁকিয়ে পড়তে দেরি আছে। তবু যতটা পড়েছে ততটাতে সুখ আছে, কামড়টা নেই। কানাই ঠাকুর ভ্যান নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। ভ্যানে তিনটে বড় ডেকচি। খিচুড়ি দুটোয়, আরেকটাতে মিশেল তরকারি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাজার জমজমাট। সব্জী বাজার।
কানাই ঠাকুরের জন্ম এই গ্রামেই। এখন বয়েস বাহাত্তরের কাছাকাছি হল। জাতে ব্রাহ্মণ। কাজ ভ্যান চালানো আর ছোটোখাটো পুজো-আচ্চা। যেমন বাজারের বড় ঠাকুরের মন্দিরে কানাই ঠাকুরই পুজো করে। বাঁধা কাজ। মাসে আটশো টাকা দেয় বাজার কমিটি।
অগ্রহায়ণ পড়ল সবে। কানাই ঠাকুরের রোগা শরীরে একটা কালো চাদর জড়ানো। খালি পা। তীক্ষ্ণ নাকের ডগা, শীতটা অল্প অল্প জানান দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মাঝে মাঝে। কানাই ঠাকুর বাজারের মাঝে এসে দাঁড়ালো। ভুলো দুই বন্ধু নিয়ে অপেক্ষা করছিল। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল ভ্যানের চারদিকে। হাতের পরে হাতে ভুলো আর দুই বন্ধু গোল গোল কাগজের বাটিতে খিচুড়ি আর তরকারি দিতে শুরু করল। কানাই একটা পাশে এসে দাঁড়ালো। বিড়ি ধরালো।
বাজার কমিটির কীর্তনের খিচুড়ি। সবার ভাগ। কানাই মানুষ দেখছে। কুড়ি বছরের উপরের মানুষ মানেই আহত মানুষ। কানাই মানুষের আঘাতের দাগ দেখতে পায়। চারদিকে থিকথিক করছে আহত মানুষ। আর পাপ।
পাপকে ডেকে আনে ভালোবাসা। নাভির থেকে জন্মায় ভালোবাসা। নাভিকে ঘিরে চরকি কাটে। যদি গুরুকৃপায় হ্যাঁচকা টানে বুকের দিকে টেনে তুলে ফেলে মানুষ, ব্যস, পাপে আর কিছু করতে পারে না। কিন্তু নাভির চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে ভালোবাসা নেশা ধরায়, বুঁদ হয়ে যায় মানুষ, সেই সুযোগে ভালোবাসাকে পাপ ডেকে নেয় লিঙ্গ-গুহ্যের মিলনস্থলে। সেখানে পাপের সরাইখানা। জাল দেওয়া হচ্ছে সুরা। সুরায় জগত ভুল হয়ে যায়। মনে হয় এই সুরাতেই জীবন কেটে যাবে। যা কড়া স্বাদ।
কাটে না। কানাই জীবন দিয়ে বুঝেছে। কানাইয়ের ভরা সংসার। তবু ভালোবাসা নাভির চারদিকে বারবার চরকি কেটেছে, তাকে নামিয়ে নিয়ে গেছে লিঙ্গ-গুহ্যের সরাইখানায়। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, কানাই তবু নেশা ছাড়তে পারেনি। ভালোবাসার নেশা। গুরু ইশারা করেছে, কানাই এই সময় হ্যাঁচকা টান মার… মার… মার…
কানাই টানেনি। নাভির নীচে গড়িয়ে গেছে মন। ভালোবাসা। কানাই পাপী। সবাই পাপী। বুকের ভিতর সরাইখানা থেকে ঘড়া ঘড়া মদ আনায় মানুষ তারপর। যা হতে পারত দেবালয়, সেই হয় বাজার, মদের বাজার। তখন চোখে জিভে নেশা। ঘোর। নিজেকে মারে, অন্যকে মারে। আহত মানুষ বাজারে ঘোরে, শিকার খোঁজে, শিকার হয়।
ভিড় বাড়ছে। কানাই বিড়িটা ফেলে এগিয়ে গেল। হাত লাগালো।
=====
আলপনার শরীর আর আগের মত দেয় না। কিন্তু বাজারটা করবে কে? তাই রাত বাড়ার আগে আগেই বাজারে চলে এসেছে। সুগার আর বাত তাকে কাবু করে ফেলেছে। বাজারে ভিড় কিসের? ওহ, কানাই ঠাকুর ভ্যানে প্রসাদ এনেছে। খাবে? সুগারটা বেড়েছে পুজোর পর। ছেলে খ্যাঁচায়। বর বিছানায় শুয়ে শুয়েই মুখ করে। যেন সংসারে সব লোভ তার একার। হ্যাঁ লোভ তার আছে। লোভ আছে বলেই সংসার আছে। মেয়েমানুষ বলেই যে লোভকে লালন করে ঘর বাঁধতে পেরেছে। তাই ঘর হয়েছে। ঘর সংসার ওভাবেই হয়। শেষে সেই সংসারের কাছেই তাকে নাকি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। একি কথা? মেয়েমানুষকে সংসারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বলা মানে বাজার থেকে আনা জ্যান্ত মাছকে আঁশবটি, হলুদ-নুন আর গরম তেলের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বলা।
লোভ ছিল বলে সংসারে ঢুকেছিল। লোভ ছিল বলে মেয়েটার পর ছেলেটাকে পেটে ধরেছিল। লোভ ছিল বলেই তো না খেয়েপরে হোক, মেয়ে আর ছেলেটাকে মানুষ করতে চেয়েছিল ভালো পড়িয়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো। কম খরচ! আলপনা সেলাই করত। তার বর একটা প্রাইভেট ফার্মে ক্লার্ক ছিল। কতটাকা আসত মাস গেলে বাড়িতে?
ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার এখন। বাজার ঘুরলেই যে সবুজ দোতলা বাড়িটা, ওটাই তাদের। হ্যাঁ লোভ ছিল দোতলা বাড়ি হোক। পাকা বাথরুম হোক। ভালো একটা রান্নাঘর হোক। সব হয়েছে। কিন্তু কোথাও যেন সব ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছে। সবার সঙ্গে আর তাল মেলে না। জোর করে মেলাতে গেলে কেটে যায়। বিষ জন্মায় মাথায়। যত দিন যাচ্ছে একা হয়ে যাচ্ছে সে। সে বুঝতে পারছে, তাকে না হলেও চলে সংসারে। এই স্বাভাবিক। কিন্তু মেনে নিতে পারছে না। অঞ্জনা ভালো মেয়ে। ছেলের বউ। সব নিয়ে নিচ্ছে তার। রান্নাঘর, ছেলে, ঘর গোছানোর কায়দা, তরকারিতে নুন-চিনির হিসাব, পুজোর সাজ… সব নিয়ে নিচ্ছে। ছেড়ে দিলেই হয়। কিন্তু এখনও লোভ, সংসারের কেন্দ্রে থাকে সে।
ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়ালো আলপনা। কানাই ঠাকুর বিড়ি খাচ্ছে। তাকে খেয়াল করেনি। মানুষটার দৃষ্টিটা ভালো না। আগে তার বাড়ি পুজো করতে আসত। এখন আসতে দেয় না। আগে তার ওই খিদে খিদে চোখের চাহনিও ভালো লাগত। একদিন হঠাৎ আর ভালো লাগল না। নাহ, কোনো শুচিবাইয়ের জন্য না। একদিন তার মনে হল সে আর কানাই ঠাকুরের মধ্যে অনেক পার্থক্য। কানাই স্বপ্ন দেখতে জানে না। ছোটো মানুষ। ছোটোই থেকে গেল। আলপনা বড় হল। কিন্তু এই বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্নই সব দিয়ে তাকে সব কেড়ে নিল।
এক এক সময় মনে হয় আলপনার, যদি সে না চাইত এত কিছু? যদি নিজেকে এতটা নিজের লোভে পিষে যেতে না দিত। ছেলেমেয়ে দুটো পড়ত না হয় সাধারণ স্কুলে একটা। না হয় থাকত একতলা বাড়ি। না হয় মাংস হত মাসে একবার কি দুবার। না হয় সেও হত অতি নিন্মমধ্যবিত্ত। থাকত না হয় দুটো কি তিনটে ভালো শাড়ি। কি হত?
সুগার ফাস্টিং দুশো চল্লিশ এসেছে।
আলপনা ভ্যানের কাছে দাঁড়ালো। কানাই ঠাকুরই তার হাতে তুলে দিল প্রসাদ। এখন চোখের দিকে তাকায় না কারো। যতক্ষণ প্রসাদ দেবে তাকাবে না। ঈশ্বর হতে কার না সাধ যায়? এখন কানাই চাইছে। সেও চায় ঠাকুরঘরে বসে যখন। পুজো পেতে চায় মানুষ। এও লোভ। কানাই এখন মানুষের খিদের পুজো চাইছে। চেটেপুটে নিচ্ছে মানুষের লোভের পুজো, খিদের পুজো। নিক। বাড়ুক সুগার। তার বাড়ির সামনে তাকে যখন খাটে সাজিয়ে আনবে সবাই বলবে, ঘোষাল বাড়ির বউ, কি ছিল, আর এখন কি হয়েছে… সিঁদুর মাথায় চলে যাচ্ছে স্বগ্গে। মানুষ হিংসা করুক। এও লোভ। চায় মানুষ। আলপনা চাইছে। গরম খিচুড়ি গলা বেয়ে নামছে। প্রসাদ না, বিষ। লোভের বিষ। পাপ। বুকের চাঙড় খসে, তার গভীরের অন্ধকার থেকে জন্মায় লোভ।
=======
গায়ে ফুল হাতা জামা। তার উপর পরা হাফ সোয়েটারটা। কাঠের দোকানে কাজ করে। তার কাজ কাঠ চেরা। মালিক মরেছে হার্ট অ্যাটাকে, এই দোকানেই। এখন তার ছেলে মালিক। খুব বাজে ব্যবহার। নোংরা ব্যবহার। এক একবার মনে হয় হাতের কাছে যা আছে দিই মাথায় বসিয়ে। এত ঝাঁঝ কোথা থেকে জন্মায়?
গণেশের বয়েস হয়েছে ষাটের উপর। ঝুঁকেও গেছে সামনের দিকে। অনেকক্ষণ ধরে দেখছে কানাই প্রসাদের ভ্যান নিয়ে এসেছে বাজারে। আরে ওই পুজোয় তো এই গণেশ পালের চাঁদাও আছে, নাকি! কিন্তু দোকানে বসে বসে মোবাইলে খচখচ করে যাচ্ছে নতুন মালিক। শকুন একটা। এখন উঠতে গেলেই বাপবাপান্ত করে ছাড়বে। ওদিকে ভ্যান নিয়ে চলে যাচ্ছে কানাই। এবার?
আচমকা মাথাটা গরম হয়ে গেল গণেশের। খিচুড়ি খেয়ে আসছি - বলে হন হন করে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। ইচ্ছা করছে একটা খুন হয়ে যাক।
দাদা ভ্যানটা কোনদিকে?
ওই যে, যাচ্ছে।
গণেশ হনহন করে হাঁটছে। কানাই ঠাকুরকে দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছা করেই কানাই ভ্যানটা সরিয়ে নিয়েছে এখান থেকে। গণেশের বাবা রাগের মাথায় শিরা ফেটে মরেছে। তাকেই মারতে গিয়ে। মদ খেয়ে পড়েছিল ধানক্ষেতে। বাবা ছিল কনস্টেবল। গণেশকে ভালো স্কুলেও পড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু গণেশের স্কুল হল না। এক বন্ধুকে ছুরি বসিয়ে দিল হাতে। কেন সে কাবেরীর সঙ্গে আসবে স্কুলে, এক সাইকেলে? ক্লাস নাইন। জেল হল। বাবা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বার করল যখন, তখন তার স্কুলের বয়েস পেরিয়েছে। কিছু কাজ নেই। এখানে ওখানে মদ খেয়ে পড়ে থাকে। বাবা তুলে আনে। বোঝায়। একদিন বেল্টটা খুলে বেধড়ক মারতে শুরু করল। কিচ্ছু বলেনি গণেশ। তার মা চীৎকার করে কাঁদছিল, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, ছেলেটা মরে যাবে।
সে মরল না। বাবাটা মরল। তার তো ভালোই লাগছিল মার খেতে। মা বোঝেনি।
গণেশ খিচুড়ি নিয়ে বারের ঠাকুরের মন্দিরের সামনে বসল। বারের ঠাকুরকে মানে সে। এই ঠাকুরের বিশাল রাগ। রাগটাই স্পষ্ট করে বোঝে গণেশ। ভালোবাসা, স্নেহ, নরম কথা - সব ন্যাকামি। ছল মানুষের। মানুষ রাগকে সমঝিয়ে চলে। মানুষ মাত্রেই রাগী, সুযোগ বুঝে রাগ দেখায়, নয় কুত্তার মত কেঁউ কেঁউ করে। একবার বাজারে এক পাগলা কুকুর তাকে কামড়ে ধরেছিল পায়ে। গণেশ পা থেকে কুকুরটার মাথাটা ছাড়িয়ে সামনেই রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইঁট দিয়ে মাথা থেঁতলে মেরে দিয়েছিল।
মাথাটাই থেঁতলেছিল। মাথাতেই জন্মায় রাগ। তারপর ঘাড় বেয়ে নামে। হাত, বুক কব্জা করে নেয়। পা সব শেষে। গরম খিচুড়ি পেটে যত নামছে শান্ত হচ্ছে রাগ। সাপ গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। এবার সব ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। মাথা টলবে। পা চলবে না। বউ টেকেনি। মার সহ্য করেও ছিল। যেদিন ছোটো ছেলেটা জ্বরে ভুগে মরল, ঈশ্বরের রাগ সহ্য করতে পারল না। মাগী গলায় দড়ি দিল। ঈশ্বরের রাগ সহ্য করতে পারে গণেশ খালি।
দোকানের দিকে তাকালো। জয়ন্ত তাকাচ্ছে তার দিকে। জিভ লকলক করছে খারাপ কথা বলার জন্য। শালা শুয়োরের বাচ্চাটা উঠে খিচুড়িও আনতে যাবে না। অথচ হাতে করে এনে দিলে গিলবে।
গণেশ আবার হনহন করে হাঁটছে। কানাই আবার খিচুড়ি দিল। কানাই শালা একটা মাগীবাজ মাল! ঈশ্বরের রাগ সহ্য করে আছে। কেঁউ কেঁউ করে। ও নাকি ভক্তি! মর মর!
হাতে করে গরম খিচুড়ি আনছে। মালিকের ছেলের জন্য। শালা জাত হারামিটার জন্য। যেন নিজের ছেলের জন্য আনছে। হাঁটুর বয়েসী তো তার! কান্না পাচ্ছে। রাগের কান্না। সেও ভালোবাসতে চায়। তার ভালোবাসাটা রাগ হয়ে যায়। মার হয়ে যায়। তাকে কেউ বোঝে না। বারের ঠাকুরও ভালোবাসে। কেউ বোঝে না। রাগে তার মাথা ঠিক থাকে না বলেই ভয় পায় সবাই। রাগ মাথা থেকে জন্মায়। তারপর ঘাড় বেয়ে নামে। তারপর….
ছেলেটা বাঁচুক, বউটা বাঁচুক, সেও তো চেয়েছিল। তার মার খেয়েই বাঁচত না হয়। কি হত!
বারের ঠাকুরের সামনে বসে পড়ল গণেশ। গলা দাবিয়ে কান্না আসছে। বউটার জন্য, ছেলেটার জন্য। মর মর সব। সেও মরবে। আজই মরবে। মালিকের ছেলেটার হাতে গরম খিচুড়িটা তুলে দিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। আজই দেবে। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ তার। প্রচণ্ড।