ঠিক কোথায় খেইটা হারিয়ে গেল। রমেশ বুঝলই না। পুরো জীবনটাই যেন হুস করে এক ভাঁড় চায়ের মত ফুরিয়ে গেল। মানুষ কতবার খোলস ত্যাগ করে। নতুন মানুষ হয়। বারবার নতুন হয়। কিন্তু ভালো লাগে কি? আগের বারের খাঁচার জন্য মন খারাপ করে না?
রমেশ মন খারাপ লাগলে পুরী আসে। দোকান
বন্ধ থাকে। চায়ের দোকান। কাঁচরাপাড়ায়। বেশ চালু দোকান। রমেশ মানুষের রুচি বোঝে। রুচিভেদে
মানুষ ভেদ। রমেশ কত মানুষের কথা শোনে। এক এক সময় হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষের সমস্যার শেষ
নেই। কত সমস্যা মানুষ নিজেই বানায়। নিজেকে খোলামেলায় রাখতে মানুষ ভয় পায়। হারিয়ে ফেলার
ভয়।
রমেশ আজ অনেক সকালে এসেছে বীচে। রমেশের
কেউ নেই। বউ ছেলে চার বছরের মধ্যে মরেছে। রমেশ বলে আমার বুকে পাঁজরে হাড় নেই, শ্মশানের
কাঠ দিয়ে বানানো। চিতা জ্বলছে। মানুষের বয়েস হলে পাঁজরের হাড় বদলে যায়। কাউকে না কাউকে
হারায় মানুষ। তার স্মৃতি দিয়ে একটা করে পাঁজর তৈরি হয়। মাঝে মাঝে টনটন করে। কাউকে বলা
যায় না। দোকান ফাঁকা। একটা কাক ডাকছে হয় তো। হঠাৎ করে একটা পাঁজর টনটন করে উঠল। যেন
পাঁজরে ঠুকরে দিল কেউ। এ হয়, সবার হয়। কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। নিজেকে না বুঝতে পারলে
মানুষ অকারণে অস্থির হয়। নিজেকে না বোঝাতে পারলে অভিমানী হয়। খুব অভিমান জমলে পুরী
চলে আসে রমেশ। সমুদ্রের হাতে অঢেল সময়।
রমেশ এবার একা আসেনি। শ্যামা ঘুমাচ্ছে
হোটেলে। শ্যামাও একা। বর ছেড়ে গেছে। ছেলেপুলে নেই। নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। তার দোকানে
চায়ের টানে আসত। ক্রমে চায়ের টানের উপর হালকা সর পড়ল, তার টানের। রমেশের প্রথম প্রথম
সংকোচ হত। কিন্তু কেন হবে? সেদিন চায়ের দোকানে বসে। মুষুলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে মানুষ
বাইরে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের মধ্যে সেঁধোয়। ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে পুরোনো স্মৃতির
খড় উঠিয়ে পুরোনো উষ্মা খোঁজে। রমেশ হাতড়ে হাতড়ে নিজের ভিতর ঢুকছিল, এমন সময় অত বৃষ্টির
মধ্যে সাতাশ নাম্বার বাস থেকে নামল শ্যামা। সালোয়ারকামিজ পুরো ভিজে চপচপ। তার দোকানে
এসে দাঁড়ালো। রমেশ পুড়ল। অনেকদিন পর পুড়তে পুড়তে বুঝল বাঁচার রসদ ফুরিয়ে যায়নি। সে
নিজেই বেচাকেনা বন্ধ করে অসময়ে ঝাঁপ ফেলেছিল। শ্যামা বলল, বড় গ্লাসে চা দাও রমেশদা।
এই নাও আদা এনেছি, দুজনের মত বসাও। আমি তোমার দোকানের ভিতরে গিয়ে শুকনো জামা পরে নিই।
চায়ের দোকানের ভিতরে একটা ছোটো ঘর।
ভাঁড়ার ঘর। কি অনায়াসে ঢুকে গেল মেয়েটা। যেন রোজ যায়। যেন কি অধিকার তার সব কিছুতেই।
রমেশের মনে হল সে যেন আকাশ ভাঙা বৃষ্টিঝরা পাহাড়ে ঝাঁপ দিল উত্তাল তিস্তায়। রমেশ জানলই
না কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে সে অন্ধকার ভাঁড়ার ঘরে। চোখ তীরের মত বিঁধেছিল শ্যামার নাভিতে।
অত অন্ধকারে মানুষ দেখে কি আলোয়? শ্যামা দাঁড়িয়ে, একটুও অপ্রস্তুত নয়। যেন অপেক্ষা
করেছিল। শ্যামা হেসেছিল শুধু। বাইরে উনুনে চাপানো ওথলানো দুধপোড়া গন্ধ যায়নি ভাঁড়ার
ঘর অবধি। দরদী বৃষ্টি এসে আগুনের আঁচ কমিয়ে দিয়েছিল। সময় দিয়েছিল তাদের।
রমেশ সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে।
শ্যামা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। আগের মত করে নয়। শ্যামার মত করে। তারা বিয়ের
কথা বলে না। নিজেদের কথা বলে। ফেলে আসা জীবনের কথা। নিজেদের পাঁজরের কথা। ভবিষ্যতের
কথা বলে না তারা। ভবিষ্যৎ মানে হাওয়া। সেখানে বীজ বুনে কি হবে? জীবন মানে এই তো। এই
যে একটার পর একটা ঢেউ উঠে ফিরে যাওয়া। এইটুকু তো জীবন। মহাসমুদ্রের হিসাব রাখে না ঢেউ।
বাতাসের সঙ্গে মিশে যেটুকু অস্তিস্ত্ব, সেটুকুতেই তার খেলা শেষ।
রমেশ ছোটো গ্লাসে চা নিল শ্যামার জন্য।
সঙ্গে দুটো বিস্কুট। শ্যামা ঘুম ভাঙলেও উঠবে না। অপেক্ষা করবে তার জন্য। দু গ্লাস গরম
চায়ের জন্য। এইটুকু অপেক্ষা জীবনে সবার জন্য কোথাও রাখা থাক, জগন্নাথদেবের কাছে এই
প্রার্থনা। রমেশ কোনোদিন নিজের একার জন্য কিছু চায় না। মা শিখিয়েছিলেন।
রমেশ ফিরছে। সমুদ্রকে বলে গেল, আসছি।