যতীন তার মেয়েকে নিয়ে রথ দেখাতে এসেছিল। শুনল রথ চলবে না এ বছর। যতীনের চার বছরের মেয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করছে, বাবা রথ কই রে? বাবা রথ কই? বাবা জগন্নাথ কই বাবা?
যতীন এ গ্রামে আসেনি আগে। এ গ্রামে আসতে রেলে চাপতে হয়। টাকা লাগে। তার অতটাকা কই? কিন্তু গেল বছর মেয়েটা যখন ভীষণ অসুখে পড়ল, সে জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করেছিল, প্রভু তুমি যদি মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও, তবে তোমার রথের দিন আমি পাঁচটাকার বাতাসা লুট দেব, হরিগ্রামে গিয়েই দেব। হরিগ্রামের রথের কথা দূর দূর অবধি প্রসিদ্ধ।
যতীন দেখে রাস্তায় রাস্তায় জমায়েত। মানুষের মুখগুলো শোকে ভার। কি হয়েছে গো? যতীন মেয়েকে কোলে করে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
একজন বলল, আমাদের বড় মোহান্ত মারা গেছেন। আমরা অনাথ হয়েছি দাদা।
লোকটার বলতে গিয়ে গলা বুজে এলো।
যতীন জিজ্ঞাসা করল, উনিই বুঝি জগন্নাথদেবের পূজারী ছিলেন?
সে বলল, না না। উনি এক অন্য মানুষ ছিলেন।
যতীন বলল, এত মানুষের চোখে জল, কান্না কেন?
সে বলল, মোহান্ত অনেক মানুষের কান্না থামিয়েছিলেন যে… তাই…
যতীনের মেয়ে বলল, রথ চলবে না বাবা?
যতীন কিছু বলার আগেই সে ব্যক্তি বলল, না মা। তোমরা কোত্থেকে এসেছ?
মেয়েটা বলল, আমরা রেলে চেপে এসেছি তো… সেই বৈঁচিগ্রাম থেকে।
সে বলল, সে রাস্তা তো অনেকটা… তারপর যতীনের দিকে তাকিয়ে বলল, খেয়েছেন কিছু?
যতীন হ্যাঁ বা না বলার আগেই মেয়েটা বলল, না তো কাকু… আমার নাম মানসী… তুমি তো আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে না… আমি নিজে থেকেই বললাম… তোমার কাছে গুড় রুটি আছে… বাবা আর আমি খাই…
যতীনের কান মুখ লাল হয়ে গেল। খিদে যে পাইনি তা তো নয়… তাই বলে এইভাবে… ছি ছি.. মেয়েটা আদরে আদরে বড় আস্কারা পেয়ে গেছে…
সে বড় বড় চোখ করে বলল, অমন বলতে হয় মা… আমরা রেল স্টেশানের দোকান থেকে খেয়ে নেব না হয় কিছু… চলো…
মেয়েটা বলল, আমার কি তোমায় বলা অন্যায় হল কাকু? কিন্তু আমার যে সত্যিই খিদে লেগেছে, তুমি পেটে হাতটা দিয়ে দেখো কাকু… পেটটা ঢুকে গেছে…
সে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। বলল, মা, আমার নাম অতীন.. আমি তোমার কাকু হই… আমায় খিদের কথা বলবে না তো কাকে বলবে.. আমার বাড়ি চলো, আমারও তোমার মত একটা মেয়ে আছে… চলো মা…
যতীন হাতজোড় করে বলল, ছি ছি দাদা…ও ছেলেমানুষ… আপনি ওর কথা নেবেন না ওভাবে… খিদে আমাদের বাপমেয়েতে পেয়েছে ঠিক… কিন্তু তা বলে আপনার বাড়ি গিয়ে আপনাদের বিব্রত করব.. একি ঠিক… ছি ছি…
অতীন বলল, হাতজোড় করে বলল, দেখুন আজ যদি বড় মোহন্ত থাকতেন তবে আপনাদের নিয়ে আশ্রমেই চলে যেতাম। কিন্তু তিনি নেই বলেই কি তাঁর শিক্ষাদীক্ষাও সব ভাসিয়ে দেব… আসুন অনুগ্রহ করে…
বলতে বলত অতীনের চোখের কোল ভিজে এলো। যতীন বলল, জানি না উনি কে ছিলেন দাদা… তবে যিনি এত মানুষকে এভাবে কাঁদাতে পারেন তিনি যে সামান্য কেউ নন সে বুঝি….
অতীন বলল, দাদা, আজ যদি ধুলোবালি, গাছপালা, পুকুর মাঠঘাটের কথা আমরা শুনতে পেতাম তবে জানতাম ওরাও কাঁদছে… সে সে সোনার মানুষ দাদা… সাধন বলতে ছিল মানুষ… মানুষের মধ্যেই সব বলতেন… বলেন
========
অতীনের ঘরের দরজায় পা দিতেই ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ এলো। কিন্তু আওয়াজটা অন্যরকম। মানসী বলল, কে কাঁদছে গো…
একটা বাচ্চা মাটির দালানে বসে কাঁদছে। তার মা তাকে বুঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিছু একটা।
মানসী তাড়াতাড়ি বাবার কোল থেকে নেমে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে বসে বলল, কি হয়েছে বোন? আমায় বল.. কি হয়েছে?
ওর মা বলল, ও কথা বলতে পারে না মা… তুমি কে?
অতীন এতক্ষণে পাশে এসে বসেছে। শুভ্রাকে সবটা বলল। শুভ্রা সবটা শুনে বলল, হা জগন্নাথ.. আজই আমার বাড়ির উনুনে আমি আঁচটুকু দিতে পারিনি…
যতীন লজ্জা পেয়ে বলল, ছি ছি… আপনি বিব্রত হবেন না….
অতীন বাধা দিয়ে বলল, কি হয়েছে…
শুভ্রা বলল, তুমি তো চলে গেলে। তারপর থেকে মেয়ের বায়না রথ দেখতে যাবে। আমি বোঝাতেই পারছি না…
শুভ্রার গলা ধরে এলো।
যতীন বুঝল শোকের কারণ অনেক। সে বলল, আপনি ব্যস্ত হবেন না…
ইতিমধ্যে মানসী সবটা শুনে বলল, আমি তোমাকে রথ দেখাতে নিয়ে যাব বোন.. তুমি খেয়ে নাও… কাকিমা শোনো… তোমার বাড়ি চিঁড়ে দই নেই… আমাদের তাই দাও না গো… বড্ড খিদে লেগেছে… আমরা রথ দেখতে যাব…
অতীন বলল তাই আনো শুভ্রা…. আজ হয় তো গুরুদেবের তাই ইচ্ছা….
যতীন বলল, আপনারা সবাই কি ওনার কাছেই দীক্ষিত?
অতীন বলল, উনি মন্ত্রদীক্ষা দিতেন না… বলতেন ঈশ্বরের নাম স্নেহের সঙ্গে নিলেই হল… ভালোবাসা ছোলার অঙ্কুরের মত.. স্নেহে জন্মায়… বড় হয়…
মানসী বলল, কাকু ওর জন্য নতুন জামা বার করো….
অতীন বলল, কিন্তু রথ তো…
আহা, তুমি আনো না কাকু… রথ চলে কি না চলে আমি দেখছি…
যতীন মেয়েকে চেনে। সে বাধা দিল না।
========
চিঁড়ে-দই খেয়ে সবাই আশ্রমের দিকে এগোলো। রাস্তায় যাকেই দেখে মানসী তাকেই বলে, এসো এসো রথের রশি টানবে… এসো গো এসো।
শুভ্রার কোলে জবা হেসে ওঠে হাততালি দিয়ে। যেন সব শুনতে পাচ্ছে। বলতে চেষ্টা করে রথ…. যেন সত্যিই সে বলতে পারে।
কিছু কিছু মানুষ সত্যিই তাদের সঙ্গে যেতে শুরু করল। যতীন তাদের বলতে চেষ্টা করল, ও ছেলেমানুষ… এ গ্রামে নতুন… আপনারা অনুগ্রহ করে ফিরে যান…
তারা বলল, যাই না… আশ্রমেই তো যাচ্ছি…
তারা মানসীর সঙ্গে গল্প শুরু করল। মানসীও হাজার একটা গল্প শুরু করল। দেখতে দেখতে আশ্রম এসে গেল। বাইরে রথ রাখা। শূন্য রথ।
এত মানুষ এই অসময়ে আশ্রমে দেখে ছোটো মোহান্ত এগিয়ে এসে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো…
মানসী বলল, আমরা দূর থেকে এসেছি, আচ্ছা না হয় আমার কথা ছাড়ো… এই যে বাচ্চাটা সকাল থেকে কেঁদে যাচ্ছে রথের জন্য সে খবর রাখো?
ছোটো মোহান্ত বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে মা?
অতীন সবটা খুলে বলল।
ছোটো মোহান্ত বললেন, দেখো মা…
মানসী বলল, তুমি কি বলবে আমি জানি… আমায় আগে বলো জগন্নাথকে সকালের ভোগ দেওয়া হয়েছে?
ছোটো মোহান্ত বলল, হ্যাঁ, দই চিঁড়ে… কেন বলো তো মা?
মানসী বলল, সে যদি রথে না চড়তে চায় তবে সিংহাসন থেকে তাকে নামালো কে?
ছোটো মোহান্ত বলল, কই মা? প্রভু তো সিংহাসনেই বিরাজমান…
মানসী বলল, চলো তো দেখি…
সবাই মন্দিরের দিকে এগোলো।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। ভোগ দেওয়া বলে। দরজা খুলতেই সবাই বিস্মিত। তাই তো, প্রভু যে মাটিতে…
মানসী এগিয়ে গেল। জগন্নাথদেবকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, চলো তো… একদিন মাত্র বেড়াতে নিয়ে যাবে তাতেও কত… এসো… সে এগোতে এগোতে শুভ্রাকে বলল, কাকিমা তুমি বোনের কোলে বলরামকে দাও… আর বাবা তুমি সুভদ্রাকে নিয়ে এসো কোলে করে… আমায় যেমন করে নাও…
শুভ্রা তাকালো ছোটো মোহান্তর দিকে। তিনি বললেন, নাও মা কোলে নাও… আমাকে এ আশ্রমেই থাকতে হবে… এই অবধি আমার হুকুম চলে, ও তো জগতের মালিকের হুকুম নিয়ে এসেছে…না ও নাও… তোমরা প্রস্তুত হও…গ্রামে ঘোষণা করে দাও প্রভু আসছেন…
বড় মোহান্তর সমাধিতে ধূপ, দীপ জ্বালা হল। সে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে গেল সারা গ্রাম। সারা গ্রাম সেজে উঠল দেখতে দেখতে। শুরু হল নামসঙ্কীর্তন। আকাশ বাতাসে খোলের শব্দ, মৃদঙ্গের শব্দ। উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি উঠল। রথের উপর জগন্নাথকে কোলে নিয়ে বসে মানসী, বলরামকে কোলে করে জবা আর সুভদ্রাকে কোলে নিয়ে বসে যতীন। মানসী বলেছে আমাকে যেমন কোলে করো তেমনই।
কিন্তু কোলে বসে কেন? মানসী বলল, আমার কোল থেকে নামবেই না… চেষ্টা করেই দেখো…
ছোটো মোহান্ত বলল, নামার তো কোনো কারণ দেখি না মা… এ আদর দিতে আমরা ভুলেছি বলেই যে না প্রভু আমাদের নিয়মের জিনিস হয়েছেন। বাচ্চার কান্না অবধি কানে এসে পৌঁছায় না। তুমি ওনাকে কোলেই রাখো, এই আমাদের অনুরোধে। আজ প্রভু জড়রথে চড়বেন না। জীবন রথে চড়বেন বলেই তোমাকে ডেকে এনেছেন। নইলে তোমার ডাকে এমন স্বাভাবিক সাড়া জাগল কেন সবার প্রাণে? বড় মোহান্ত বলতেন, তিনি যখন ডাক পাঠান তখন সে ডাকে সাড়া না দিয়ে গতি থাকে না মানুষের… তাঁর ডাকই তাঁর পরিচয়… যে ডাকে সাড়া দিয়েই মুক্তি… ক্ষুদ্রতা থেকে।
মানসী সবটা শুনে বলল, বাবা তুমি ওনাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দাও… আমাদের সেই বাতাসার মানতটা গো… নইলে আবার উনি মন্ত্র পড়ে পড়ে বেড়াতে যাওয়াটাই মাটি করবেন…
ছোটো মোহান্তর সঙ্গে সবাই হেসে উঠল। সঙ্কীর্তনের আনন্দে মিশে গেল খোলা প্রাণের আনন্দ, খোলের শব্দে মাতোয়ারা হয়ে।