Skip to main content

একজন বন্দী ছাড়া পেলে কেমন লাগে? খুব আনন্দ লাগে? প্রাণ নেচে ওঠে?

এ সব কল্পনা। বাস্তবে ভীষণ কনফিউজড্ লাগে। মানুষ অভ্যাসের দাস। স্বপ্নের দাস তো নয়। ও যতই স্বপ্ন দেখুক মানুষ, আসলে অভ্যাসের বাইরে পা বাড়ায় ক'জন?

হাতের সিগারেটটা শেষ। জেটিতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনন্ত। বন্ধু। নিতে এসেছে। মুখটা গঙ্গার দিকে করে দাঁড়িয়ে। বাদামী রঙ করা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। এক কাপ চা আর একটা কেক সকাল থেকে খাওয়া হয়েছে। বাড়ি গিয়ে ভাত পাওয়া যাবে। নিজের বাড়ি না। অনন্তের বাড়ি। ওর বউ অপেক্ষা করছে। জেল ফেরৎ আসামীর জন্য।

ভীষণ কনফিউজড্ লাগছে। শুনতে হাসি পেলেও, আসলে ইনসিকিউরড্ লাগছে। জেলের মধ্যে এতটা ইনসিকিউরিটি ছিল না। ওখানেও অনেক গোলমাল। কিন্তু সিস্টেমটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল। এখন?

লঞ্চ আসছে।

=======

উঠলাম না। এটা আমাদের লঞ্চ না। ওই যে বললাম ভীষণ কনফিউজড্। জেল থেকে বেরিয়েছি আমায় কেউ চিনে ফেলবে এতে আমার কোনো চাপ নেই, কিন্তু এই যে লঞ্চটায় উঠব বলে এগোলাম, অনন্ত হাতের ইশারায় বসতে বলে বলল, শালা গাণ্ডু নাকি, এটা আমাদের লঞ্চ?

ব্যস্..., আমার মাথা-কান গরম হয়ে গেল। এই হয়। লজ্জা ঠিক না। কেমন যেন মিসফিট।

অনন্ত ধার্মিক। ওর বাবা পুজো করত। আসার সময় একটা শিবমন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুজো দেওয়ালো। আমার মনটায় কি একটা হল, মনে মনে বললাম, এই ভালো আছো। বন্দী। মন্দিরে। সব বন্দী। মন্দিরে, মসজিদে, চার্চে, গুরুদুয়ারায়।

প্রশ্ন উঠছে তো, কেন জেলে গিয়েছিলাম? সে উত্তর বছর ছয়েক আগে হলে দিতাম। প্রচণ্ড যুক্তি সাজিয়ে, নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য হয় তো আপনার গলাও টিপে ধরতাম….. ওহ্ সরি…. ভাষাটা গোলমাল হয়ে গেছে….. আসলে স্থানমাহাত্ম্য.... জেলের ভাত খেয়েছি অ্যাদ্দিন…. বুঝলেন…. আমি চাইতাম আপনার চোখে আমার জন্য করুণা…. একটু দরদ….

এখন চাই না…. এখন আপনার ঠাণ্ডা শীতল চোখ… সন্দেহের চোখে তৃপ্তি পাই… বেঁচে আছি মনে হয়…. এই যে বারবার নিজেকে প্রমাণ করার জন্য জীবনের অর্ধেক আয়ু খুইয়ে বসে আছি…. সব বেকার…. নিজেকে প্রমাণ কার কাছে? আর কেনই বা?

অনন্ত ডাকছে…. লঞ্চ এসেছে….

=======

অনন্ত আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আসলে আমার বাড়িতেই ও খেয়ে-পরে মানুষ। ওর বাবা পুজো করতেন বলেছিলাম। তারপর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ওর মা ওকে আর ওর বোনকে নিয়ে অথৈজলে পড়ে। আমার বাবা তখনের সরকারের পার্টির বেশ বড়সড় লোক ছিলেন। ওর মায়ের একটা ব্যবস্থা লোকাল স্কুলে করে দেন। ওর বোনটার জেলে থাকতেই শুনেছি বিয়ে হয়ে গেছে। ও আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত। ভালো চাকরি করে এখন। পড়াশোনায় ভালো ছিল। মা মারা গেছে। সে-ও জেলে থাকতেই জেনেছিলাম। আমার মা-বাবা? নেই। একটা অ্যাক্সিডেন্টে।

লোকে বলে আমি নাকি অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই বদলে গেছি। আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় আসলে আমি যা, তাই হয়েছি। আগে সাহস ছিল না, হয় তো বাবার ভয়ে। যা বলতে সাহস লাগে.... বলে দিই... এখন সব বলে দিই... আর তাই....

অনন্ত কথা বলবে না। বরাবরই কম কথা বলে। ভুঁড়ি ছিল। এখন ছিপছিপে। সুগার নাকি খুব। চশমাটা স্টাইলের। চুল এখনও রঙ করে। ওর একটা ছেলে আছে। দার্জিলিং-এ পড়ে।

অনন্ত চেয়েছিল ভালো উকিল দিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি বার করে আনতে। আমি হতে দিইনি। এ যেন ঋণ উশুল করে নেওয়া। ও আমাদের কাছে ঋণী বলে আমাকেও হতে হবে? তাছাড়া আমার যা স্বভাব আমি কদ্দিন বাইরে থাকব তারই বা কী গ্যারান্টি আছে? তার চাইতে এই ভালো। কিন্তু আমি জানি জগৎ এদিক ওদিক হয়ে গেলেও অনন্ত আমায় ছাড়বে না। কৃতজ্ঞ বলে না। ও আমায় কোথাও ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। আমিও করি, আমাকে। ওটা না করলে বাঁচা যায় না। কেন করি? কারণ আমি নিরপেক্ষ বলে।

=======

'নিরপেক্ষতা' মানে কি? এটাই খুঁজছি। আর খুঁড়ছি। শুধু খুঁজলে হয় তো সাধু হয়ে যেতাম। লোকজনকে বেশ মিষ্টি মিষ্টি উপদেশ দিতাম। কিন্তু আমি শুধু খুঁজি না, খুঁড়িও। সেইখানেই আমার যত সমস্যা। আসলে সমাজ হল শতাব্দীর কবরস্থান। আমি খুঁড়ি। ক'টা লোক বেঁচে আছে মশায়? নিজের গায়ে ঘি মাখিয়ে পড়ে আছে। চিতায় ওঠার অপেক্ষায় দিন গোনে।

আমি সেই কবর খুঁড়ে ফেলি। মাঝে মাঝেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলি। বিশেষ করে রাজনীতিতে। নাহ্, পার্লামেন্টের কথা বলছি না। ওখানে তো জাহাজের খবর। আমি আদার কেনাবেচায় প্রশ্ন তুলি। কথায় না পোষালে গায়ে হাত তুলে দিই। আসলে আমি অহিংসায় বিশ্বাসী। মহাত্মাকে মানি। কিন্তু সহিংস পথে অহিংসায় আসি। আসলে নিরপেক্ষতা মানেই হিংসা। ভালো করে দেখুন। এই যে গোটা সমাজটা চোখে ঠুলি পরে বসে আছে... কমিটিতে কমিটিতে ভরে আছে। মিটিং-মিছিলে কানে তালা। কেউ গরু-রক্ষা কমিটি খুলছে, কেউ কুকুর-রক্ষা কমিটি খুলছে, কেউ পরিবেশ, কেউ নদী, কেউ মাটি….. এরা কেউ নিরপেক্ষ? কেউ না। এরা একটা নেশায় মেতেছে। নেশা ভালো। নেশা মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষতার দাবীকে ধামাচাপা দেয়। একটা দিকে ঝোঁক টেনে চলে। সেই চলাটা অবশ্যই বেশ গৌরবের হয়। অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়। সেই ভোলাতে আমাদের ধর্ম, ঈশ্বর, রাজনীতি, কমিটি এইসব লাগে।

দেখুন, ওইদিকে দেখুন… আরে ওই যে… মা'টা ঘুমিয়ে পড়ছে…. কোলে বাচ্চাটা… তবু ওর বাবা কোলে নেবে না…. বারবার বউটাকে ঠেলে জাগিয়ে দিচ্ছে… কেন… তুই তো কিছুই করছিস না… কাগজ পড়ছিস…. নে কোলে…আপনারা দাঁড়ান… দু'ঘা দিয়ে আসি…. বললাম না… আদার কারবারি ভুল হলে বড় গায়ে লাগে….

=======

ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন… দাদা আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি…. আজই অ্যাসাইলাম থেকে ছেড়েছে…. দাদা প্লিজ…. প্লিজ… দাদা…..

দেখুন অনন্তকে….. কিভাবে কাকুতি-মিনতি করছে আমার জন্যে… মায়া লাগে দেখলে…. আর বউটার দিকে দেখুন…. আমার দিকে তাকিয়ে…. শ্রদ্ধায়… আসলে আমায় দেখছে না…. নিরপেক্ষতাকে দেখছে…. নিরপেক্ষতা মানে হিংসা…. এক অহিংস হিংসা…. তাণ্ডব…..

হ্যাঁ… আমি পাগলা গারদ থেকে ফিরছি…. জেল কেন বলেছিলাম? সব পাগল তাই…. মানুষের চিন্তার স্ক্যান করলে দেখতেন…. কত রক্ত লেগে….. শুধু নিজের না…. অন্যেরও…. নিরপেক্ষ হতে না পেরে মানুষ নিজেকে খুন করে…. তারপর খুন করা অভ্যাস হয়ে যায়…. যাকে তাকে যখন তখন খুন করে…. চিন্তায়…. বাইরে সে সব বললে লোকে বলে পাগল…. নিরপেক্ষতা বন্দী না করলে সমাজ টেকে না….. তাই আমাকে বন্দী করে ওরা…. ওটা জেলই….