চন্দনার মাথাটা গরম ছিলই। চারটে বাড়ি কাজ। সমস্যা হয় মুখার্জি বাড়ির বৌদিকে নিয়ে। জন্মের শুচিবাই। অতগুলো বিছানার চাদর কেউ একসঙ্গে ভেজায়? জানে না এই এক সপ্তা হল ডেঙ্গু থেকে উঠেছে চন্দনা! লোকের বাড়ি খেটে খায় বলে কি মানুষ না!
কোমরটা টাটাচ্ছিল। সারাটা রাস্তা গজগজ করতে করতে এসেছে চন্দনা। ভাদ্রের রোদ আর প্যাচপেচে গরমে শরীরের জ্বালা মনের জ্বালাকে আরো দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এমনিতেই এই অনাসৃষ্টি বৃষ্টিতে কাজ নেই মহিমের। বাড়িতে বসা পুরুষমানুষ দু চক্ষে দেখতে পারে না চন্দনা। কিন্তু তার কপাল!
চন্দনার সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। দুটো বিস্কুট আর চা খেয়ে গিয়েছিল। ফিরল যখন বেলা একটার কাছাকাছি। এখন রান্না বসাবে। ঢুকতেই মহিম বলল, পাড়া থেকে চাঁদার জন্য এসেছিল। করোনায় ভালো করে পুজো হয়নি দু বছর। তাই এবারে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিন খাওয়াবে, এক হাজার টাকা চাঁদা বলে গেছে!
চন্দনা প্রথমে কিছু বলল না। মাথাটা দপদপ করছে। বুকটায় ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। একে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। জায়গায় দেখাতে হবে। আসলে পয়সা না থাকলে এরা মানুষ বলেই গণ্য করে না। এই যে পাশে এত বড় বাড়ি বানাচ্ছে সরকারেরা, টাকা কোত্থেকে আসছে জানতে কারো বাকি নেই! সে করুক। কিন্তু সারা বাড়ি জল জমিয়ে জমিয়ে যে ডেঙ্গুর মশা চাষ করে রেখেছে, সেই বেলা? পাড়া, পঞ্চায়েত, কেউ কিছু বলল? কেউ না। সব চুপ। আর তার বাড়ির একটা ফাঁকা টবে জল জমেছিল বলে কত কথা শুনিয়ে গিয়েছিল দু বছর আগে! ডেঙ্গুটা কার হল?
এক হাজার টাকা!
পুকুরে ডুব দিয়ে চন্দনা মাথাটা ডুবিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। চন্দনা পারে। বুকে দম আছে। নইলে এ জোয়াল কে ঠেলত? আবার মাথা তুলল। মাথার উপর চাঁদি ফাটা রোদ। তবু জলে ডুবে বলে লাগছে না। এক হাজার টাকা!
আজকাল তো অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতেও যায় না চন্দনা। যত রাজ্যের পচাধচা ফুল, ঝুরোপাতা তাদের হাতে দেবে। দাঁড়াতেও জায়গা পাওয়া যাবে না ঠিক করে! মায়ের মাথার উপর বাঁ বাঁ করে ফ্যান ঘুরছে। বড়লোকেরা, উঁচুজাতেরা সব ছাওয়ায় দাঁড়িয়ে। আর তাদের লোকেরা বাইরে, তাদের ছেলেমেয়েরা রোদে ভুরু, কপাল কুঁচকে বাইরে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবে। কেন রে? তোদের গা কাটলে কি নীল রক্ত বেরোয়? না সবুজ?
মহিম শুয়ে পড়েছে। ভাত নামালে স্নানে যাবে। স্নান করে এসে খিদে সহ্য করতে পারে না মানুষটা। চন্দনা সব তরকারি কেটে একটা ঘ্যাঁট চাপালো। দুটো ডিমসিদ্ধ দিয়ে দেবে, হয়ে যাবে খাওয়া। মহিমের মুখের দিকে তাকালো। রাগটা পড়ে গেছে কখন। খিদে পাচ্ছে।
========
বলছিলাম যে, আমি পাঁচশোর বেশি দিতে পারব না ভাই… নিলে নাও… নইলে থাক।
বিশু মোটরসাইকেল থেকে না নেমেই তার দিকে তাকিয়ে। মুখে বিরক্তি। হেলমেটটা খুলে বলল, কেন যে এরকম করেন বৌদি….
জানো না দাদার কাজ নেই… মেয়েটার বিয়ে হল গেল বছর..নতুন কুটুমবাড়ি.. গরীব বলে কি আমাদের দেওয়াথোয়া নেই… ক'টা বাড়ি কাজ করে আর কতদিক সামলাব বলো তো….
তোমারই তো দোষ বৌদি…. আমরা তো ক্লাব থেকে বলি মাসে মাসে দিয়ে দাও… গায়ে লাগবে না….
চন্দনার কানের ভিতরটা দবদব করছে আবার। রাগটা চেপে বলল,
কার গায়ে কি লাগে সে খবর বাইরে থেকে বোঝা যায়? কার সংসারে কি সমস্যা বাইরে থেকে বোঝা যায়?
হাজার চাপতে চেষ্টা করুক, একটু ঝাঁঝ বেরিয়েই এলো চন্দনার গলায়।
বিশু বলল, আচ্ছা আমি দেখছি দাদার কাজের জন্য কাউকে কাউকে বলে….
বিশু চলে গেল। চন্দনা জানে এ ফাঁকা কথা। বরং চাঁদা না দিলে আরো কয়েকটা কাজের জায়গা বন্ধ করে দেবে… এই করে দু বছর মহিম কলকাতায় কাজ করেছে। এদিকে কেউ কাজই দেয়নি।
=======
শোনো না… জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লড়ে কি হবে বলো…. করোনার পর থেকে কলকাতায় যেতে তো আমার ভয় তুমি জানোই…. তা ছাড়া আমার সহ্যও হয় না বাইরের খাবার… তার চাইতে তুমি দাস বৌদির কাছ থেকে টাকাটা ধার করে এনে এদের দিয়ে দাও… উনি না হয় তোমার মাইনে থেকে কেটে নেবেন…..
চন্দনা উত্তর করল না। এতদিন সংসার করে শিখেছে কোন কথার উত্তর হয়, আর কোন কথার উত্তর হয় না।
মহিম ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে এসে দাঁড়ালো চন্দনা। গুমোট রাত। আবার একটা নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে সমুদ্রে। নিম্নচাপ মানে বৃষ্টি। অলুক্ষুণে বৃষ্টি।
হাঁটতে হাঁটতে প্যাণ্ডেল অবধি এলো চন্দনা। বাঁশগুলোর ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটা বাঁশের উপর বসল। দীর্ঘশ্বাস পড়ল কেন কে জানে! নিজের হাতটা সামনে আনল। কড়া পড়ে গেছে। বাসন মেজে মেজে। চোদ্দোবাড়ির এঁটোকাঁটা ধুয়ে যাবে আজীবন! কান্না পেলো। কদিন পর এখানে মা আসবেন। কত হইচই, মাইক, নাচগান হবে। তারা দূরে থাকবে। তাদের কেউ সম্মান দিয়ে ডাকবে না…. গা বাঁচিয়ে চলবে…. আজকাল দোকান থেকে শুধু না… মোবাইলে কি করলে প্যাকেটে করে বাড়ি এসে শাড়ি দিয়ে যায়…. তার জামাই নাকি অর্ডার দিয়েছে একটা লাল শাড়ি তার জন্যে… বাইকে করে বাড়ি এসে প্যাকেটে করে দিয়ে যাবে….
চন্দনার হাসি পেল। চোখ চলকে জল এলো। মহিমের ভীতু গলার আওয়াজটা মনে এলো। এক হাজার দেবে না। আটশো দেবে। নিয়ে নেবে বিশু। জানে চন্দনা। প্যাণ্ডেলে প্রণাম করে চন্দনা বলল, মা আমি কাজে যাওয়ার সময় দূর থেকেই প্রণাম করে যাব…. এখন এই জানিয়ে গেলাম… সবাইকে ভালো রেখো।
চন্দনা বাড়ি ফিরছে। ফাঁকা রাস্তা। গুমোট গরম। এক আকাশ নীরব তারা। অর্ধেক বাঁধা প্যাণ্ডেলে এসে ঢুকল একটা ঘেয়ো কুকুর।