রিকশাটা একদম দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করাতে চাইছে বয়স্ক মানুষটা…. কিন্তু সেখানেই একটা কুকুর লেজ গুটিয়ে শুয়ে… তাড়াতে ইতস্তত করতে করতেই রিকশাটার সামনের চাকাটা গড়াচ্ছে… এই হ্যাট.. হ্যাট…..
কুকুরটা উঠল। রিকশাটার সামনের চাকাটা গায়ে লাগতেই, অল্প ধাক্কা খেয়ে, ঘুমের ঘোর কাটিয়ে দৌড়ে সামনের যে ফ্ল্যাটটা তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে ঢুকে গেল।
চালক নামল। তাকালো কিছুক্ষণ কুকুরটার দিকে। অন্ধকারে ভালো ঠাহর করতে পারল না। মুখে একটা অস্বস্তি।
"স্টেশান যাবেন?"
চালক তাকালো। একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, পাশে একজন মহিলা। মহিলার হাতে পুজোর ডালা। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ। ভদ্রলোক ঘামছেন কুলকুল করে। আসলে একটা ভ্যাপসা গরম আছে তো! আকাশেও মেঘ মনে হয়। রাত ন'টার কাছাকাছি হবে।
না দাদা, আজ আর যাব না….
ভদ্রলোক মুখটা বিকৃত করে বললেন, নবাবপুত্তুর সব…. চলো ওদিকে দেখি…..
রিকশাচালক আবার ফ্ল্যাটের নীচের অন্ধকারে তাকালো। সে তখন সামনের মিষ্টির দোকানের রাস্তার পাশে কিছু ফেলে দেওয়া খাবার খাচ্ছে। লেজ নাড়িয়ে।
রিকশা চালকের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। লাগেনি তবে!
======
রিকশার সিটটা তুলে একটা লাল কার্ড বার করল। লুঙ্গির নীচের দিকটা তুলে সেটা দিয়ে কার্ডটা মুছে মন্দিরের দিকে এগোলো। এই যে সামনে বড় চাতাল, এখানে বড় বড় গাড়ি, বাইক এনে লোকেরা পুজো দেয়। গাড়ির সামনে পুরোহিত সিঁদুর দিয়ে কি একটা আঁকে। মালা পরায় গাড়িতে। তার আসা হয়নি। এটা সেকেন্ডহ্যান্ড রিকশা। তাই আর পুজো দেয়নি।
মন্দিরে মায়ের পুজো চলছে। সাত আটজন বসে। মায়ের সামনে বসে পুরোহিত। পুজোর ডালা নিচ্ছে, গোত্র জিজ্ঞাসা করছে, পুজো দিচ্ছে, মায়ের পায়ের ফুল মিষ্টির প্যাকেটটা খুলে দিচ্ছে, একটা মিষ্টি মায়ের পায়ের সামনে থালায় রাখছে।
মিষ্টি…. তাই তো….
ডানহাতে ভর দিয়ে সে আবার উঠল। কিছুটা তাড়াতাড়ি হেঁটেই সামনের মিষ্টির দোকানের সামনে এসে দাঁডালো। কুকুরটা তার রিকশার নীচে শুয়ে।
চারটে সন্দেশ… হ্যাঁ ওই… পাঁচ টাকা করে?
======
আর দু’জন। তাদের পুজো হয়ে গেল। পুরোহিতকে প্রণামী দিয়ে বেরিয়ে গেল পুজোর ডালা নিয়ে।
সে এগোলো। লালকার্ডটা আর মিষ্টির প্যাকেটটা পুরোহিতের হাতে দিয়ে বলল, মাকে দিতে এসেছি… সামনের মাসে মেয়েটার বিয়ে….
বড় কাঁসার থালার ফুলপাতা গুছাতে গুছাতে পুরোহিত শুনছে। তার দিকে পিছন ফিরে বসে। মা তাকিয়ে তার দিকে। মা-ও শুনছেন। অল্প অল্প হাসছেন তার দিকে তাকিয়ে।
মিষ্টির প্যাকেটটা খুলে একটা মিষ্টি থালায় রাখল পুরোহিত। মায়ের পায়ের ফুল মিষ্টির প্যাকেটে দিয়ে পুরোহিত বলল, মেয়ের মাথায় ছুঁইয়ে দিও। আর বিয়ে হয়ে গেলে মাকে প্রণাম করে যেন যায় দেখো….
সে তাকিয়ে বসে মায়ের দিকে। মা-ও তার দিকে তাকিয়ে। তার মায়ের এত গয়না ছিল না। তবে অনেক ফর্সা ছিল। গলায় একটা হার ছিল। পায়ে আঙট। তবে হাসলে এমনই লাগত দেখতে। তার মায়ের মতই পুরো হাসিটা। মা ঠিক এমন হাসত।
চোখটা ছলছল করে উঠল। মেয়েটার জন্য মনটা কঁকিয়ে উঠল। মাথাটা মেঝেতে ঠেকালো। ঠাণ্ডা মেঝে। দু ফোঁটা চোখের জল মেঝেতে পড়ল। আঙুল দিয়ে মুছে নিয়ে বলল, অস্ফুটে, মা দেখিস।
"মেয়ের কোথায় বিয়ে হচ্ছে?"
আজ্ঞে বরানগরে….. কিন্তু ছেলে কেরালায় কাজ করে…. মেয়ে নিয়ে চলে যাবে…..
পুরোহিত বলল, "আমার মেয়েটা তো…. থানাপুলিশ কিচ্ছু হল না….. পাশের পাড়ায়….. ছেলেটা আবার বিয়ে করবে…. এই একই তারিখে….."
কার্ডটা খোলা। মায়ের সামনে রাখা।
পুরোহিত বলল, কাছে দূরে বলে কিচ্ছু হয় না… সবই কপাল…..
লাল সিঁদুরের তিলক পরা কপাল ছুঁলো পুরোহিত। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, জানি না গতজন্মে কি পাপ করেছিলাম…. কিছু তো নিশ্চয়ই করেছিলাম… নইলে এতো তো মেয়ের বিয়ে হয়…. সংসার হয়… বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে….
পুরোহিত থামল। গলায় কাছে শব্দগুলো জল না পেয়ে মাছের মত ছটফট করে থামল।
রিকশাচালক উঠতে পারছে না। মা দাঁড়িয়ে। মহাদেব মায়ের দিকে তাকিয়ে। মা তার দিকে তাকিয়ে। গলায় কাটা মুণ্ডুগুলোর চোখ বন্ধ। কাটা মুণ্ডুগুলোতেও কি শান্তি। যেন ঘুমিয়ে আছে।
আপনি কোর্টে যাননি?
পুরোহিত কই? কেউ নেই সামনে।
সে উঠে দাঁড়ালো। পুরোহিত কখন উঠে ভাঁড়ার ঘরে গিয়েছিল খেয়াল করেনি। একটা শাড়ি নিয়ে এসে রিকশাচালকের হাতে দিল। বলল, মায়ের প্রসাদী শাড়ি…. মেয়েকে বোলো যত্নে রাখতে।
======
চালক রিকশার সিটের তলায় শাড়িটা রাখল। ভাগ্যের কত নিষ্ঠুরতা দেখেছে। অবাক হয় না আর। শিবের মত মানুষের মনের ভিতর একটা আত্মা থাকে। সেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ খোঁজে। সান্ত্বনা খোঁজে। পুরোহিতের মেয়েকে সে চিনতো। পুরোহিত অনেকবার তার রিকশাতেই থানায় গেছে। পুরোহিতের কান্না শুনেছে। চালাতে চালাতে না শোনার ভান করেছে। নইলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত তো।
মন্দির ফাঁকা। পৌনে দশটা। রাস্তা থেকে মাকে দেখা যাচ্ছে। পুরোহিতকে দেখা যাচ্ছে। মায়ের শয়ানের ব্যবস্থা করছে।
রিকশাটার নীচে কুকুরটা শুয়ে। একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনল। কুকুরটাকে ডাকল। কুকুরটা বাইরে আসতে, বিস্কুটগুলো ছড়িয়ে রিকশায় উঠল। কয়েকটা প্যাডেলের পর শুনল, কুঁইকুঁই ডাক। কুকুরটা দৌড়াচ্ছে। তার সঙ্গে।
রিকশা থামিয়ে নামল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুই মায়ের কাছেই থাক। আমি আবার আসব, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলেই আসব। তুই এখানেই থাক। মা আছেন। ভয় নেই।
কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে বারবার "ভয় নেই… ভয় নেই" বলতে বলতে প্যাডেলে চাপ দিল।
কুকুরটা তাকিয়ে। লেজ নাড়ছে তাকে দেখে। ফিরে তাকিয়ে দেখল পুরোহিত মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে সাইকেলে, মাকে শয়ান দিয়ে।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল ধরে শুয়ে মহাদেব। কত প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ব্যাখ্যা নেই। মায়ের অপলক চোখে তো বাদ পড়ে না কিছুই। মহাদেব তাই তাকিয়ে দেখে, অপলক।