মেয়েটা বলত, তাকে যে বিয়ে করবে সে কত টাকা যেন মাইনে না পেলে বিয়েই করবে না, বেশ বড় অঙ্কের টাকা থাকবে, চারচাকা থাকবে, বড় বাড়ি থাকবে ইত্যাদি। খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে ক্রিকেটার, অভিনেতাদের ছবি বেরোলে কেটে কেটে বইয়ের ফাঁকে রাখত। তারাই তার জন্য আদর্শ হবু বর।
সেদিন হঠাৎ দেখা হল, বিকাল বিকাল তখন, চূঁচুড়ায় একটা গলির মোড়ে। মাথায় সিঁদুর, পাশে বছর তিনেকের একটা মেয়ে। আমার সে পূর্বপরিচিতা হেসে বলল, "দাদা এসো না, সামনের ওই মোড়টার পরের পরের বাড়িটাই আমার। ও বাড়ি আছে। আলাপ হবে, বিয়েতে তো তুমি আসতে পারোনি।"
আমি ওকেই দেখছিলাম। লাল শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর, স্বাস্থ্য আগের চাইতে বেশ ভালো, বড় বড় চোখের মণিদুটো শুধু একই রকম, সেই অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর। পরিবর্তন এসেছে সামান্যই। কৌতুহলপারা চঞ্চলতাটা সরিয়ে সে যেন কোথাও একটা স্থৈর্য পেয়েছে। পেয়েছে, না নিজেকে বুঝিয়েছে?
একটা সরুগলির মধ্যে ঢুকে তার বাড়ি পৌঁছালাম। ছোটো ছোটো দুটো বেডরুম, একচিলতে বারান্দা, একফালি রান্নাঘর, আর তার পাশে বাথরুম। আমায় "বোসো" বলেই একগাল হেসে বেরিয়ে গেল। তার স্বামী এসে ঢুকল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। মেয়েটার থেকে আর না হোক পনেরো-ষোলো বছরের বড়। মাথার সামনের দিকে টাক। স্থূলকায়। একটা লুঙ্গী আর স্যান্ডোগেঞ্জি পরে আধমোড়া, আধাপড়া খবরের কাগজ নিয়ে আমার সামনে বসতে বসতেই হাত জোড় করে নমস্কার জানালো। আমিও জানালাম। মুখের ভাব যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, "হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ওর সাথে।"
"আরে তাতে কি হয়েছে... আপনার কথা কত শুনেছি... আপনি ওদের সাথে নিজের দাদার মত মিশতেন, স্যারের মত না...."
খাটের পাশে আলনা। তাতে আটপৌরে ক'টা কাপড়, বাচ্চার জামাকাপড়, লুঙ্গী, গামছা। তার পাশে আলমারি পিছনের জানলাটা ঢেকে। আলমারির গায়ে পুরীর জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা চুম্বকে আটকে, চিপকে। দেওয়ালে লোকনাথ বাবা, তারকেশ্বরের শিব। দরজার ডানদিকে ড্রেসিংটেবিল। তার এককোণে ওদের বিয়ের ছবি। আয়নায় খুলে রাখা টিপ।
"দাদা, তোমার চা, দেখো লিকার বানিয়েছি"... সম্বিৎ ফিরল। ওকে আবার ভালো করে দেখলাম। নাহ্, কোনো আপশোস বা অনুশোচনা চোখে পড়ছে না। তার স্বামীর বড় বাজারে নিজের ছোটোখাটো একটা দোকান। আজ যায়নি, ওদের একটা বিয়ে বাড়ি আছে। ভালোই হল, আমায় তাড়াতাড়ি ফিরতেও হবে।
মেয়েটা রাস্তা অবধি ছাড়তে এলো, আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। কেমন একটা কষ্টলাগা আর অস্থিরতা যুগপৎ কাজ করছে। আচমকা তাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, "হ্যাঁ রে, তুই সত্যিই ভালো আছিস তো?"
সে আমার মুখের দিকে খানিক অবাক হয়ে তাকালো। তারপর খুব বড় একটা হাসি হেসে বলল, "ওমা থাকব না কেন গো, ও খুব ভালো, তুমি কখনও একটু বেশি সময় নিয়ে এসো, ওর সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগবে।"
লঞ্চ ছাড়ল। কত কথা কানে আসছে। আমি যেন কি ভেবেই চলেছি। মনটা হতভম্ব হয়ে গেছে। কোথাও একটা সাজানো ঘুঁটিগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। যেরকম হিসাবে সংসারটা পুরুষ সাজায় সেটা বড্ড ওপরসা ওপরসা। তার তত্ত্ব আছে, দর্শন আছে, আরো অনেক কিছু আছে যা নিয়ে বিজ্ঞ মহলে, পণ্ডিত মহলে গর্ব করা চলে। কিন্তু কি একটা যেন নেই তার জিম্মায়। নিত্য জীবনের ধারাবাহিক চেনা পথ যেন তার পৌরুষের কাছে নগণ্য। সেই যাকে সে তুচ্ছ, অতিসাধারণ বলে, নিজের কাছে, দশের কাছে প্রচার করে বেড়ায়, সেই অতিতুচ্ছের কাছে পরাভব স্বীকার করার মত হীনমন্যতা সংসারে বোধহয় খুব কমই আছে।
লঞ্চ এক পাড় ছেড়ে অন্য পাড়ের দিকে। মন এখনও চুপ। সে অভিযোগ কিম্বা প্রতিবাদ জানাবে মেয়েটার হয়ে সংসারের কাছে? না মাথা পেতে এ চিরকালীন অতিবাস্তব ঘটনাটাকে স্বীকার করে নেবে বুঝে উঠতে পারছে না। সহসা পাশে বসা এক মহিলার কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙল। তার কোলে একটা বছর পাঁচেকের ছেলে। সে প্রশ্ন করে চলেছে, ভদ্রমহিলা উত্তর দিয়ে চলেছেন। লঞ্চটা জল কেটে তার গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে। গন্তব্যের দিকে এগোতে দিশা আর গতি তো দুই লাগে, না? কিন্তু কোনটার জন্যে কোনটাকে কখন কতখানি আপোষ করে নিতে হয় সে হিসাব কে দেবে?
লঞ্চ এ পাড়ে ভিড়ল। মন কি ভিড়ল কোথাও?