আজকাল আর টানতে পারি না মা… শ্বাস আটকে আসে….. ওই করোনা হল… তারপর থেকে…..
কেউ শুনল না। কেউ শোনেও না। তার নামগান সম্পূর্ণ হল কিনা কজন খেয়াল রাখে? একটা কি দুটো টাকা দিয়ে চলে যায়।
চা খেয়ে বিহারীদাসী স্টেশানে বসে বসে সামনের অশ্বত্থগাছটার দিকে তাকিয়ে। বেলা হয়েছে। বারোটা হবে। শীতটা এবার বড় ভুগিয়েছে বিহারীদাসীকে। কাশি থামতেই চায় না। তার উপর শ্বাসকষ্ট। যেন বুকের মধ্যেটা ফাঁকা বাক্স একটা। বাতাস ঢোকে না।
অশ্বত্থগাছের পাতাগুলো একটা হাওয়ার দমকে মরমর করে উঠল। চিন্তার সুতো ছিঁড়ল বিহারীর। ফাঁকা স্টেশান। কতদিন হল বিহারী?
প্রায় তিরিশ বছর। আগে দু’জনে আসত। এখন সে নেই। তাও আট বছর হল। ক্লান্তিটা বেড়েছে সেই থেকে। একটা ঝিনঝিনি ক্লান্তি।
একটা অল্পবয়েসী ছেলে, বাদাম বিক্রি করে ট্রেনে। সামনের বসার জায়গাটায় বসে বিড়ি খাচ্ছে। চুলগুলোর রঙ নীল। কালো জ্যাকেট গায়ে। পায়ে কালো ফুটো ফুটো জুতো। সামনের দিকে তাকিয়ে একটা বাচ্চা কুকুরকে ডাকছে। বাচ্চা কুকুরটা একটা প্লাস্টিক নিয়ে খেলছে।
বিহারীর মনে হল এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? বড্ড মায়া লাগে। উনি চলে গেছেন। তাও মায়া কাটল কই? মায়া কাটল না বলে নিজের উপর রাগ লাগে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ক্লান্ত হয়। ক্লান্তি লাগে।
এই… এই ভাই…. সিগারেট খাচ্ছ কেন…. এত অল্প বয়েস…..
ছেলেটা তাকালো। উত্তর দিল না।
শেষ কথাটা ধীরে ধীরে বলল, বাড়িতে কে কে আছে……
ছেলেটা উঠে কুকুরের বাচ্চাটার কাছে গেল। বিহারীর মনে হল তারও উঠে যাওয়া উচিৎ ছিল ছেলেটার কাছে।
কোমরটা টাটালেও গিয়ে বসল বিহারী। কুকুরটার কাছে। বাচ্চাটার কাছে।
ছেলেটা বলল, তুমি ট্রেনে ভিক্ষা করো না?…. তুমি কি ছোটোবেলা থেকেই ভিখারি?
বিহারী কি উত্তর দেবে? এত স্পষ্টভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তো। তাও এই বারো তেরো বছরের মানুষটাকে কি উত্তর দেবে?
হ্যাঁ বাবা, ছোটোবেলা থেকেই…..
কুকুরের গায়ে হাত দেয় না বিহারী। কিন্তু কুকুরটা তার কোলের কাছে চলে আসছে। শাড়িটা কামড়াচ্ছে খেলার ছলে। ছেলেটা বলল, তোমার সঙ্গে খেলতে চাইছে।
বিহারী হাসল। ছেলেটা বিহারীর হাঁটুর উপর হাত দিয়ে বলল, বিস্কুট কিনবে?
বিহারী তাকালো ছেলেটার দিকে। এতদিন পাথরের মূর্তির সামনে বসেছে। পাথরের গোপালের চোখ দেখেছে। তার ব্যথায়, কান্নায়, হাসিতে, আদরে সে চোখ তার দিকে একইভাবে তাকিয়েছে। বিহারী সে চোখের ভাষা নিজের ভাষায় বানিয়ে নিয়েছে। বিহারীর উনি বিহারীকে বলতেন, “ওগো, এ জগত এক অশ্রুত ভাষায় লেখা। যে যার নিজের ভাষায় তাকে অনুবাদ করে নেয়।”
এতদিন বিহারী গোপালের চোখের ভাষা অনুবাদ করেছে নিজের ভাষায়। কিন্তু এ চোখ তো….. জ্যান্ত চোখকে এড়ায় কি করে মানুষ!
ছেলেটার চোখে কাজল। ছেলেটা বলল, আমিও টাকা দিচ্ছি… তুমি দুটো টাকা দাও…..
বিহারী বলল, তুই কিছু খাবি ভাই?
বিহারীর মনে হল বুকের মধ্যে লোহার বল দিয়ে ধাক্কা মারল কে যেন…. সে ধাক্কা গলায় এসে আটকে গেল।
ছেলেটা বলল, ওই দোকানে ভালো কচুরী বানায়…. তুমি খাবে?
বিহারী বাইরে খায় না তো। কোনোদিন খায়নি। প্রসাদ ছাড়া মুখে দিতে নেই কিছু।
ছেলেটা বলল, তুমি না খেলে থাক….
বিহারী বলল না, বিহারীর জিভ বলল, চল খাব।
বিহারী, ছেলেটা আর কুকুরটা এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনে।
দুটো কাগজের প্লেটে চারটে করে কচুরী আর আলুর তরকারি দিল। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল বিহারীর। খিদেতে। ছেলেটা গোগ্রাসে খাচ্ছে। একটা টুকরো ছিঁড়ে দিচ্ছে কুকুরটাকে। সে লেজ নাড়াতে নাড়াতে খাচ্ছে। তাকাচ্ছে ছেলেটার দিকে। তার দিকে।
বিহারী ইষ্টমন্ত্র পড়ল। মনে সুখ এলো না। খাবার শুদ্ধ হবে কি করে? বিহারী তাকালো ছেলেটার দিকে। তাকাতে তাকাতে বলল, এই নে ভাই…. বিহারী দিল না। বিহারীর হাত, পাঁচটা আঙুলে এক টুকরো কচুরী আলুতে মাখিয়ে বাচ্চাটার হাঁ মুখের দিকে এগিয়ে গেল। বিহারী বুঝতেই পারল না বিহারী নিজেই কি চাইছে….
ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত। ছেলেটার চোখের উপর অশ্বত্থ গাছের ছায়া। ছেলেটার চোখে যেন জল।
খাবার শুদ্ধ বিহারীর এখন। খেল। মানবিক তৃপ্তিতে।
ট্রেনে উঠবে। ছেলেটা অন্য ট্রেনে যাবে। উল্টোদিকে।
বিহারী ছেলেটার রঙ করা চুলে হাত বুলিয়ে বলল, আসিস ভাই… মদনপুরে নেবে, বলবি…
ছেলেটাকে ঠিকানাটা সবটা বলল। না চাইতেও বলল। মায়াতে জড়িয়ে ধরছে জেনেও বলল। কুকুরটা কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না যেন। ছেলেটা পা দিয়ে দিয়ে আদর করছে।
বিহারী ট্রেনে উঠল। ফাঁকাই আছে। ছেলেটা চলে যাচ্ছে। কুকুরটা একা দাঁড়িয়ে। আর অশ্বত্থগাছটা। বিহারীর অস্বস্তি লাগছে। কি নেই যেন। কি নেই? বিহারী শরীরের ক্লান্তিটাকে খুঁজছে। কই সে?