Skip to main content

সাইকেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে খৈনি ডলতে ডলতে সামনের দিকে তাকালো। জবা নামছে স্নান করতে।

অমল চলতে পারে না। একটা কিছুতে ভর দিয়ে সাইকেলে ওঠে। সাইকেল গড়িয়ে চলে গ্রাম থেকে গ্রামে। অমল কিছু লোকের জমায়েত দেখলে দাঁড়ায়। হাত পাতে।

এই অমল আট বছর আগে মুম্বাইতে কাজ করত। মাসে একটা নির্দিষ্ট দিন মাইনে পেত। গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাত। নতুন বিয়ে। বউ আনার কথা হচ্ছিল মুম্বাইতে। কিন্তু তার আগেই কি রোগে ধরল। ডাক্তার বলল আর সারবে না। ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি সব খারাপ হবে।

পাখি ছেড়ে গেল অমলকে চার বছর হল। শহরে থাকে। একটা বাচ্চা তাদের। মেয়ে। ময়না। পাখিকে ময়নাকে দেখে না প্রায় তিন বছর হল। মন সব সময়েই এমন বিকল হয়ে থাকে যে আলাদা করে মেয়ে বউয়ের জন্য মন খারাপ বুঝতে পারে না। বুঝতে চায়ও না। বাবা মা মরল গেরাম গরমে এক সাথে। প্রায় চোদ্দজন মারা গিয়েছিল সেবার গেরাম গরম রোগে। চিতা নিভতে পারছিল না। তিনদিনে সব শেষ। নস্করপাড়ার গুনিন বলল, এ গ্রাম বাঁধোনি কেন তোমরা? গোটা গ্রাম বাঁধতে খরচ কত জানো? প্রায় বারো হাজার টাকা।

ন’হাজারে গ্রাম বেঁধে গেল গুনিন। গ্রাম শান্ত হল। সেসব নিজের চোখে দেখেনি অমল, শুনেছে। বলে নাকি সে গুনিন গ্রাম বেঁধে আসছে, পিছনে আগুনের হল্কা উড়ে উড়ে আসছে। রাক্ষসের কান্না শোনা যেত রাতে রেয়াত দীঘির ওপার থেকে। ওই খেয়েছে এতবাড়ির মানুষকে। তার বাবা মাকেও।

======

জবা পাখির খুড়তুতো বোন। পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল। বরটা মাতাল। জবা এখানেই থাকে। অমলকে দেখতে পাচ্ছে কিনা জানে না অমল। চাইছে না দেখুক। অশ্বত্থ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অমল। ওপারে চড়া রোদ। জবা ভালো করে খেয়াল না করলে দেখতে পাবে কি? এমনিতেই দেখতে না পাওয়ারই কথা। অমল কালো।

পিছনে সাইকেলের বেল দিল কেউ। অমল ফিরে তাকালো। বলাই। বলল, ভাই, আজ কলকাতা থেকে মাসিরা আসছে মেয়ে দেখতে। মা বলল, আমাদের বাড়িতেই খেয়ে নিস আজ।

অমল বলল, কার জন্য রে, বড়ভাই না ছোটোভাইটার জন্য?

বলাই বলল, আরে বড়টা তো বিয়েই করবে না। ছোটোভাইটার জন্য।

অমল বলল, আমাদের গ্রামের মেয়ে?

বলাই বলল, না না, পোড়াশিবতলার মেয়ে।

বলাই চলে গেল। অমল সাইকেলটা গাছে হেলান দিয়ে, গাছটা ধরে ধরে বসল। মাটিটা ভিজে। কাল বৃষ্টি হয়েছে না সারারাত। জবা ডুব দিল।

বলাই অমলের বন্ধু। ছোটোবেলার বন্ধু। ভালোমন্দ রান্না হলে ডাকে। মাকে খুব ভালোবাসত বলাইয়ের মা।

পা দুটো সামনে ছড়ালো। ফোলা ফোলা পা দুটো। পেটটাও ফুলছে দু সপ্তাহ হল। এগুলো ভালো লক্ষণ না। মেজো জেঠুর হয়েছিল। লিভার পচে গিয়েছিল। তারও কি তাই? হবেও বা। আজকাল কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। তবু যাবে। কেউ ডেকে আদর করে খাওয়ালে ভালো লাগে। তাই যাবে।

জবা যদি সাঁতার কেটে এদিকে আসত একবার। বসত যদি তার পাশে। এদিকে তো কেউ আসেনা। অমল আসে শুধু। রোজ। এই দশটা থেকে এগারোটা, কি বারোটা। দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাজারের দিকে যায়। ভাঙা বাজারে যা পায় কিনে বাড়ি যায়। কোনোদিন খায়, কোনোদিন খায় না।

======

একটা প্লেটে চারটে মিষ্টি দিয়ে গেল কাকিমা। পাঁঠা রান্না হচ্ছে। গন্ধ আসছে। বলাইয়ের বউ ছেলেমেয়ে নেই। ওদের মামাবাড়ি গেছে। কালীপুজো আছে আজ রাতে। বলাইও যাবে। অমলকেও অনেকবার বলে গেছে বলাইয়ের বউ, লক্ষ্মী। তাকে দাদা ডাকে। ফোঁটা দেয়।

অমল একা বসে আছে একটা ঘরে। বসার ঘরে হাসি হইহই হচ্ছে। বলাইদের অবস্থা বরাবরই ভালো। গ্রামে সব চাইতে বড় বাড়ি এটাই। দোতলা। বলাইদের অনেক চাষের জমি। তাছাড়া কৃষ্ণনগরে প্রায় দশ বারোটা বাস চলে।

বলাই এসে বলল, পাখি এসেছে। ময়নাকে নিয়ে। আমি স্টেশানে নামতে দেখলাম। যাবি?

অমল হাঁ করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ বলাইয়ের দিকে। বলাইয়ের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। কেমন লাগছে বুকের ভেতরটা। ঘাম হচ্ছে। খুব ভয় করছে। কেন এল? সব তো মেনে নিয়েই কাউকে না জ্বালিয়ে মারা যাচ্ছিল সে। একা একাই। তবে কেন?

অমল উঠে গেল। সাইকেলটা নিয়ে যতটা কম শব্দ হয় সেইভাবেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। গ্রামে যাবে না। পাখিদের বাপের বাড়ির দিকে যাবে না। কাউকে মুখ দেখাবে না। আজ ভীষণ লজ্জার দিন তার। কিন্তু মেয়েটা? এত লজ্জা কেন দেয় ঈশ্বর তাকে?

অমল স্টেশানের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সাইকেলটা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে আপ প্লাটফর্মে উঠল। ছোটো স্টেশান। পাখি যাবে ডাউন প্লাটফর্মে। ময়না যদি চিনে ফেলে তাকে? এতটা লজ্জা ছিল তার বুকে? তুবড়ির মত ফেটে ফেটে বেরোচ্ছে লজ্জা তার। ছি ছি। কিচ্ছু কর‍তে পারেনি মেয়েটার জন্য। পাখি ঠিক করেছে। তার সঙ্গে এ গ্রামে থেকে কি হত? বেশ করেছে।

দুপুর আড়াইটে হবে। একটা দোকানের আড়ালে সাইকেলটা রেখে প্লাটফর্মের মাটিতেই বসে আছে অমল। খিদে পাচ্ছে। পাক। হয় তো বিকেলের ট্রেনে ফিরবে ওরা। ওর বাবাকে দেখতে এসেছে হয় তো। ওর বাবা কোনোদিন কোনো কাজ করেনি। পাখির ঠাকুমা কল্যানী নার্সিংহোমে কাজ করত। আয়ার কাজ। ওর বাবা, সিধুকাকা, মাসের চার তারিখ গিয়ে টাকা নিয়ে আসত। গ্রামে সবাই কি নিন্দা করত। কিন্তু ওর বাবা কান দিত না। সিধুকাকা বাড়ির সব কাজ করত। আর কাকি বড়ি দিত, সেলাই করত। কাকিই বিয়ে ঠিক করেছিল পাখির সঙ্গে তার। অমল যে কদিন ডেকেছে কাকা-কাকিই ডেকেছে। ছোটোবেলার অভ্যাস। কাকি মারা গেছে। কাকার নাকি ক্যান্সার। গলায়। কবিরাজি করছে। খারাপ অবস্থা। তাই পাখি এসেছে।

অমলের সিধুকাকার মুখটা মনে পড়ছে। সিধুকাকাকে দেখে সব সময় মনে হত কুঁড়ে। এইভাবে মায়ের টাকায় সংসার চালায়? কিছুই কি কাজ পারে না? অমল এখন নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবে অমলকাকার কি কোনো রোগ ছিল? সব রোগ কি বাইরে থেকে দেখা যায়?

আচমকা শরীরটা অস্থির লাগতে শুরু করল অমলের। জিভটা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘাম হচ্ছে দরদর করে। ঝিনঝিন করছে সারা শরীর। উঠতে যাবে, হঠাৎ, চোখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বুকটা চাপ ধরে এলো। মনে হল ডাউন ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। হ্যাঁ ডাউন ট্রেনই তো।

======

পাখি আর ময়না যখন স্টেশানে এসেছে ততক্ষণে অন্যদিকের প্ল্যাটফর্মে অনেকে ভিড় করে চোখমুখে জল দিচ্ছে অমলের। কিন্তু অমল ততক্ষণে এই জল-মাটি-বাতাসের থেকে অনেক দূরে।

পাখি অন্যমনস্ক। ভেবেছিল একবার অন্তত দেখা করতে আসবে অমল। আসেনি। কি মানুষ! নিজের মেয়েটা তো আছে! পাখির অভিমান হয় না। অভিমানের মত কিছু একটা হয়ে বুকের মধ্যেই ঝুরোঝুরো হয়ে ভেঙে যায়। বেঁচে আছে শুনেছে। যদিও শাঁখা সিঁদুর মুছে ফেলেছে, তবু মেয়েটার বাবা তো সে!

ট্রেন ঢুকল। পাখি আর ময়না উঠে গেল। ওপারের প্ল্যাটফর্মে একজন ঝুঁকে পড়ে অমলের কানের কাছে ডাকছে…. অমল…. অমল….

গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আজকাল আওয়াজ বেরোয়া না। সিধু মেয়ে নাতনিকে তুলতে এসে এই প্ল্যাটফর্মে ভিড় দেখে এগিয়ে এসেছিল। এসে দেখে অমল অজ্ঞান হয়ে পড়ে। মৃতমানুষকে চিনতে সময় লাগে।