তিনি প্রতিদিন শেষ বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি, বাঁধানো গঙ্গার ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে থাকেন। গঙ্গার জলে ডোবে পা, আবার ডোবে না, জোয়ারভাটার হিসাব অনুযায়ী। চোখ ডোবে। দৃষ্টি তো ইচ্ছা নির্ভর, দৃশ্য নয়।
এই কথাটাই গঙ্গা দেখতে দেখতে ভাবেন। পিছনে তার ঘর তার জন্যে অপেক্ষা করে। আরো দূরে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে কোথাও শ্মশানের আগুন।
তিনি শুধু দেখেন। আর বলেন, দৃষ্টি তো ইচ্ছা নির্ভর, দৃশ্য তো নয়। গঙ্গার জলে শুশুকের মত ডোবে আর ওঠে শৈশব, যৌবন, দেশভাগের রক্ত, ভাষার রূপান্তর, অভাবের চালচিত্র, স্বামী, আত্মীয়, বন্ধু….
তবু কোথাও সব কিছু স্থির হয়ে আছে বুকের মধ্যে। যেমন শামুক খোলের মধ্যে নিজেক গুটিয়ে রাখে। চলে নিজের বুকের জলের দাগে ভিজিয়ে ভিজিয়ে পৃথিবীর মাটি। তিনিও চলেন। চলেছেন যবে থেকে মা গর্ভমুক্ত করেছেন তাকে নাড়ি কেটে, জুড়েছেন নাড়ি তার নিজের ভাগ্যের সঙ্গে।
বাড়ি ফেরেন। শাঁখে ফুঁ দেন বুকের অবশিষ্ট সবটুকু শ্বাস করে জড়ো। আকাশ, মাটি, পাতাল কাঁপিয়ে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি। দেবতারা তাকান তার দিকে। তিনি দুটো নকুলদানা আর জল রেখে বলেন, এসো।
পাড়ার মণ্ডপে তখন দুর্গা সপরিবারে। গরীব বস্তির গরীব পুজো। ছুটে ছুটে বেড়ানো ছেলেমেয়েদের দিকে তাকাতে তাকাতে, নিজের ভাগ্যদেবীকে বলেন, যদি তোমার কোঁচড়ে থাকে কিছু এখনও ভালো, এদের বিলিয়ে দাও। আমার জন্যে রাখো রোগ, দীর্ঘশ্বাস, কান্না, অভাব। আমার সয়ে গেছে। মৃত্যু ডিঙি বেয়ে জোয়ারভাটা পেরিয়ে আসছে আমার জন্য।
"ঠাকুমা অঞ্জলি দেবে তো?"
হাতে ফুল। চোখ বন্ধ। তিনি বলেন, দৃষ্টি ইচ্ছা নির্ভর, দৃশ্য তো নয়। মায়ের দিকে তাকান। বলেন, মা গো, পালাতে গেলে তো অজুহাত আছে মেলা, দাঁড়াতে গেলে লাগে একটাই জিনিস…. সাহস! তুমিই সেই সাহস আমার। দশভুজা!