সৌরভ ভট্টাচার্য
29 March 2020
ছাত্র। তারপর ভাইয়ের মত। বাৎসল্য, স্নেহ, প্রশ্রয়, আবদার, বকাঝকা, আদর, দুষ্টুমি, বাঁদরামি – এ সব শব্দের সঙ্গে মৃত্যু শব্দটা যায়? যায় না তো না। কিন্তু সে তো আমাদের মানুষী মায়ার অঙ্কে।
আজ সকালে জানলাম সে নেই। তারপর শুনলাম গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে। “রাত বারোটা অবধি আমার সাথে বসে গল্প করল, তারপর শুতে গেল জানেন...মাঝরাতেই...কি যে হয়ে গেল”...
আমার তো আর কিছু শোনার নেই। কত বয়েস হয়েছিল? তেইশ কি চব্বিশ হবে। গত তিন চার বছর আগে ব্রেনের একটা সমস্যা ধরা পড়েছিল, ঠিক উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে। পরীক্ষা দেওয়া হল না। কঠিন অপারেশন। সুস্থ হয়ে বাড়ি এলো। পরের বার পরীক্ষা দিল। পাশ করল। কলেজেও ভর্তি হল বায়োকেমেস্ট্রি নিয়ে। ওরা মা মারা যায় বেশ কিছু বছর আগে।
জানো দাদা, আমি মায়ের জন্য ঠাণ্ডা জল নিয়ে আসতাম স্টেশান থেকে, আমাদের বাড়ি ফ্রিজ ছিল না তো। স্কুল থেকে ফেরার সময় আমার জলের বোতলে ভরে মায়ের জন্য ঠাণ্ডা জল আনতাম। মা কি যে খুশী হত।
জানো দাদা মা যখন নার্সিংহোমে ভরতি ছিল আমায় তো রোজ নিয়ে যেত না। একদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি শুধু ঠাকুমা বাড়িতে। কেউ নেই। আমি বললাম কোথায় গেল সবাই? পাড়ার এক পিসি বলল তোর মাকে আনতে গেছে। আমার কি আনন্দ হল দাদা। যাক মা ফিরছে তাহলে। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে গেছে তাও আসে না। আমি ঘর বাইরে করছি। জানলার ধারে খাটে বই খুলে বসে আছি, পড়ায় মন বসছে না। তারপর অনেক রাতে মাকে নিয়ে এলো, খাটে শোয়ানো। আমি কাঁদিনি দাদা। আমি এমন চমকে গিয়েছিলাম, এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, আমি কাঁদিনি। অনেক পরে কেঁদেছি। অনেক পরে। আমায় তো ওদের আগে থেকেই বলা উচিৎ ছিল বলো দাদা, যে মা মারা গেছে! ভাই তখন কত বড়, এই টুস খানি...
পড়ার পর তার গল্পের ঝাঁপি খুলত। আমায় কি কি সব খেলা শেখাতো মোবাইলে। যখন তার অপারেশানের পর বাড়িতে শয্যাশায়ী, আমি প্রায়ই দেখা করতে যেতাম, সন্ধ্যের পরে। সে বলত তার আগামী দিনের পরিকল্পনা। সে গবেষণা করতে চায়। সে অনেক দেশ দেখতে চায়। মাঝে মাঝেই বলত, আমি সুস্থ হয়ে এগুলো করতে পারব তো?
আমি বলতাম, পারবি।
তারপর মাঝে মাঝেই ফোন করত, দাদা আমি কিছু মনে কেন রাখতে পারছি না, আমি কেন সব ভুলে যাচ্ছি?
আসলে মনের মধ্যে একটা টেনশান কাজ করত, যেন ও সব ভুলে যাচ্ছে, কিচ্ছু হবে না ওর দ্বারা।
এমন সরল চোখ, এমন সরল মুখ খুব কম দেখেছি। ও যখন উচ্চমাধ্যমিক দেবে তখনও ওর খুব কাছের বন্ধু যারা তাদের বয়েস ছিল দশের আশেপাশে। এর বেশি বড়রা ওর বয়েস্য হতে পারে, কিন্তু তাদের মনের সাথে ওর মনের বয়েস খাপেখাপে বসত না।
একবার বেশ কিছুদিন পড়তে এল না। তারপর যখন এলো, আমি ক্লাসে ওকে বেশ বকাঝকা করছি, ওর বাড়িতে খাটাল ছিল, ওটাই ওদের ব্যবসা, আমি বলতাম তুই গরুই হয়ে যাচ্ছিস ইত্যাদি ইত্যাদি... কিন্তু সে কোনো রা কাটে না মুখ। আমার রাগ হল ভীষণ, একে তো কামাই করেছিস এতদিন, তার কোনো সঠিক কারণও বলবে না?
ব্যাচ ছুটি হল। সবাই চলে গেল। ও গেল। আমি আমার ঘরে বসে আছি, হঠাৎ দেখি ও আবার এসেছে। ঢুকেই বলল, জানি তুমি খুব রেগে আছ, কিন্তু আমি সবার সামনে বলি কি করে বলো? তুমি জানো আমার কি হয়েছে? শোনো তবে –
আমি তো বিকালে পড়ছি খাটে বসে। ঠাকুমা চা করে নিয়ে এসেছে, এইবার চা’টা যেই দিতে যাবে ঠাকুমার হাত পিছলে এক্কেবারে ওখানে... সে কি জ্বালা গো দাদা... পুড়েই গেল যেন সব... আমি এর মধ্যে তোমার কাছে কেমন করে পড়তে আসি... প্যান্টই তো ঠিকঠাক পরতে পারছি না...
ব্যস, তারপর আমি আর ও হেসেই বাঁচিনা...তারপর মাঝে মাঝেই সেই নিয়ে ফাজলামি হত।
আমাকে নিয়ে ওর বড় সমস্যা ছিল। মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করত, তুমি সারাদিন এই চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বোর হয়ে যাও না? এত পড়ার কি আছে? চলো সাইকেল নিয়ে ঘুরে আসি, চলো ঝিলের ধারে নতুন পাখি এসেছে দেখে আসি, চলো একটু পর বাংলাদেশে যাওয়ার ট্রেনটা যাবে দেখে আসি... ও ভুলে যেত ওর বয়সের সাথে দুই গুণ করলে আমার বয়েসটার কাছাকাছি হয়। কিন্তু তা তো নয়, আমি তো ইচ্ছা করেই নাকি বুড়ো সেজে বসে আছি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম, মাঝে মাঝে মজা করতাম, মাঝে মাঝে রাগাতাম... ধুম করে সব শেষ হয়ে যেতে বসেছে বুঝতে পারিনি। পরিবারের কেউ চলে গেলে অনেক সান্ত্বনা দেওয়ার, বোঝার মানুষ পাওয়া যায়, কিন্তু ছাত্র বা ছাত্রী চলে গেলে সে যন্ত্রণা কারোর সাথেই শেয়ার করা যায় না। কারোর সাথে না। সে বাড়িতে কারোর সন্তান, আমার কাছে তার পরিচয় ছাত্র। কিন্তু এই দুই পরিচয়ের মাঝে যে মানুষটা বেড়ে উঠছে, যে ছাত্রও নয়, সন্তানও নয়? যে শুধু সারল্যে, কৌতুহলে, নানা কোমল অনুভূতিতে - অভাব, কষ্ট, যন্ত্রণা, বিচ্ছেদব্যথা ইত্যাদিতে জড়ানো মানুষ? যেগুলোর কোনো মূল্য বড়দের হিসাবি জগতে নেই, তার বলে যাওয়া সেই কথাগুলো ভুলি কি করে? তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পরম বিশ্বাসে আমার পাশে এসে বসা, নিজের মনের সবটুকু উজাড় করে সব বলে যাওয়া, সবখানে একজন গোটা মানুষের গুরুত্বহীনতাটার কষ্ট, আমার ঘরের মধ্যে খুঁজে পেয়ে আনন্দ পাওয়া...ভুলে যাব? হয় না। সংসারে আমার পাথেয় খুব বেশি কিছু নেই। এরকম কিছু মানুষের পথের সঙ্গী হতে পারা কিছুদিনের জন্যে, ব্যস, আর কিছু না।
গত পরশু তার সাথে ফোনে কথা হল কোভিড নিয়ে। আমায় হোয়াটস অ্যাপে অনেক ডাক্তারের ফোন নাম্বারসহ একটা লিস্ট পাঠালো। আমি সকাল থেকে হোয়াটস অ্যাপের মেসেজগুলো দেখেই যাচ্ছি। আমাদের লকডাউন উঠলেই দেখা করার কথা যে। অনেক কথা বলার আছে যে ওর আমার কাছে।