সৌরভ ভট্টাচার্য
20 April 2018
মালতী বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে এক ঝলক তাকালো। চাঁদিফাটা রোদ। মালতী হাইরোডের ধারের সব ধাবাগুলোতেই রাতে থাকে। ভাগ করা আছে, কোনদিন কোন ধাবাতে। তার এই ছাব্বিশ বছর বয়সে সে জানে একটাই পুঁজি তার – শরীর। মালতী শরীরের যত্ন নেয়। এখন সে একটা বিউটিপার্লার থেকেই বেরোলো। সাথে বিশ্বদীপ। তার সাথে সারাদিন ঘোরে। লোকে বলে বডিগার্ড তার। বিশ্ব মালতীকে ভালোবাসে। তার খেয়াল রাখে। বিশ্বের সাতকুলে কেউ নেই। মা-বাপ মরা। ঠাকুমার কাছে মানুষ। ঠাকুমাও মারা গেছে তার বছর ছয় হল। বিশ্বের বয়েস প্রায় মালতীর কাছাকাছি। বরং দু-চার বছরের ছোটোই হবে বিশ্ব। মালতী ঠিক ভালোবাসে না, ওই একরকম মেনে নেয় ওকে। বিশ্বের একটা বড় গুণ ওর মালতীর শরীরের ওপর কোনো লোভ নেই। মালতী তাই কিছুটা সমীহও করে বিশ্বকে। তবে ভালোবাসে না।
মালতী বাড়ির দিকে এগোলো। পিছনে পিছনে বিশ্ব। মালতীকে দেখতে ভালো। ফর্সা, ছিপছিপে, বেশ লম্বাও। বিশ্বকে কিছুটা বেঁটেই লাগে মালতীর পাশে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় ভীষণ চীৎকার। তার বাবার গলা। গালাগাল করছে। মালতী একটু দাঁড়ালো। হাতঘড়িটা দেখল – সাড়ে দশটা। পিছন ফিরে বিশ্বকে বলল, তুই যা, আমি পরে কল করে নেব। বিশ্ব মালতীর সাথে তর্ক করে না। কোনোদিনও করে নি। মালতীর মেজাজ বিগড়ে থাকলে যা মুখে আসে তাই বলে বিশ্বকে। বিশ্ব চুপ করে শোনে। চোখে জল এলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তবু কিছু বলে না। এখনও কিছু বলল না, 'আচ্ছা' বলে ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল। মালতী সামনের দিকে পা বাড়ালো। সে আজ চারদিন পর বাড়ি ফিরছে। একটা মালদার পার্টির সাথে দীঘা গিয়েছিল। কাল রাতেই ফিরেছে। বাড়িতেই ফিরত। কিন্তু মেহেবুব ধাবা থেকে ফোন করেছিল। গতকাল রাতেই এক মন্ত্রীর ছেলে থাকবে। তার কথা খুব শুনেছে, তাই রাতে তাকে চাই। মেহেবুব হোটেলেই প্রথম কাজ মালতীর। তার মা পুষ্প সাথে করে নিয়ে এসেছিল। তার কত বয়েস তখন? চোদ্দ হবে।
তাদের বাড়ি বলতে টালির চাল দেওয়া তিনটে পরপর ঘর। মাটির মেঝে। সামনে বারান্দা। তার এক কোণে রান্নাঘর। মালতী বাড়ির সামনে এসে দেখল সারা উঠোন বাসন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার বাবা চীৎকার করছে বারান্দায় বসে ঘরের দিকে মুখ করে। তার মা'কেই উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো তা সে বুঝছে। কারণ কথার মধ্যে কয়েকবার ‘মাগী’ শব্দটা শুনল। আচমকা ডান দিকের ঘর থেকে পরেশ বেরিয়ে এসেই তাকে দেখে চমকে উঠে বলল, দিদি! আমি তো ভাবলাম তুই আর ফিরবিই না...
মদন ঘুরে তাকালো। চোখদুটো লাল। মালতী বুঝল গলা অবধি ভর্তি। অবশ্য এতক্ষণ গলার আওয়াজ শুনে টের পায়নি যে তা নয়। এখন নিশ্চিত হল। মালতীকে দেখেই একটু থমকে গেল প্রথমটায়। তারপর তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার মা'কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করল আবার। তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। মালতী চমকে উঠল। তার মায়ের গায়ে গেরুয়া। কেন? মদন বলল, বুড়ি বেশ্যামাগীর এখন সন্ন্যাসী হওয়ার সাধ হয়েছে বুঝলি না? পৃথিবীর লোকগুলোর ধর্মজাত তো নষ্ট করেইছে, এখন দেবতাগুলোরে পর্যন্ত ছাড়বে না...
মালতী কান দিল না। একে মাতাল, তায় চরিত্র তুলে কথা। আগে এই শব্দগুলোর একটা মানে বুঝত এখন বোঝে না। আগে শিবরাত্রি, চৈত্রসংক্রান্তি ইত্যাদি বিশেষ দিন কাস্টমার নিত না। এখন নেয়। শুধু লোকনাথবাবা'র পূজোর দিনটা নেয় না। খুব বড় করে পূজো করে বাড়িতে।
মালতী বারান্দায় এসে বসল। পরেশের দিকে তাকিয়ে খুব করুণ সুরে বলল, একগ্লাস জল খাওয়াবি ভাই? পরেশ বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছিল। দৌড়ে উঠে গেল। মালতী পরেশের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কেন যে ছেলেটা পড়াশোনাটা ছেড়ে দিল। তার থেকে ন'বছরের ছোটো। খুব খারাপ ছিল না পড়াশোনায়। কি যে একটা নেশায় ধরল। ড্রাগ। কতদিন ড্রাগ ছাড়ানো সেন্টারে ছিল। পরেশের দিকে তাকালে একটা তীব্র কান্না উঠে আসে মালতীর বুকে। সেটা মাতৃত্ব না দিদির স্নেহ সে আলাদা করে উঠতে পারে না।
তার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, হঠাৎ?
তার মা যেন একটু লজ্জা পেল। বলল, আরে জানিস তো সামনে গাজন। তো অনেকেই গ্রামে সন্ন্যাস নেয় একমাস। এমন কি আর শক্ত নিয়ম রে? বাড়িতে নিরামিষ আঁশ ঢোকানো যাবে না। আর সহবাস করা যাবে না। ব্যস।
মালতী হেসে বলল, সহবাস মানে স্বামী না যে কারোর সাথে?
পুষ্প'র মুখটায় গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, পাপ তো জীবনে কম করিনি রে। তোকেও পাপের পথে টেনেছি..., বলতে বলতে তার গলার স্বর চড়তে লাগল..., তা এই না মুরদে একটা পুরুষের ঘর করতে গেলে তো ও ছাড়া পথ ছিল না মা... আর তুমিও তো এখন সে পথের রস বুঝেছ... কাঁচা টাকা... তা বেশ্যা বলে কি আর আমাদের ঠাকুরদেবতায় মন দিতে নেই... লোকে যেমন গায়ে গতরে খেটে খায় আমরাও তাই খেয়েছি বাছা... সাথে সমাজের লাথিঝাঁটাও... তীর্থ বলতে তো সেই কোন জম্মে একবার পুরী... তাও সেরকম এক পুরুষের সাথেই...
পরেশ আবার খেলায় মন দিয়েছে। মদন গজরাচ্ছে একটা কোণে বসে। পুষ্প চুপ করে বারান্দায় মাথা ঠেকিয়ে বসে। তার চোখ উপচে জল পড়ছে। চোখ বন্ধ। পুষ্প কোনোদিন জোরে কাঁদে না। বেশ্যার কান্নায় নাকি লোকের অমঙ্গল হয়। আসলে লোকে ঠাট্টা করে। পুষ্প সহ্য করতে পারে না। জলের গ্লাসটা মেঝেতে রেখে মালতী বলল, অশান্তিটা কি নিয়ে রে পরেশ?
পরেশ মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলল, বাবা বাড়িতে মুরগী রেঁধেছে।
পুষ্প আচমকা ডুকরে কেঁদে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। মুখে আঁচল ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার এইটুকু পুণ্যই তো সঞ্চয় মা, ওপারে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে বল? মালতী পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিল। বলল, ঠিক আছে বুঝেছি। তা তুমি কি খেয়েছ বাবা? মদন মাথা নাড়ল। পরেশ হাসি চেপে বলল, মা পুকুরে ফেলে দিয়ে এসেছে, আমি বললাম ভেড়ুকে দাও। ওর বাচ্চা হয়ে শরীরটা কি রোগা করে ফেলেছে। তা বলল, বাড়ির কুকুরও আমিষ খাবে না।
মালতী হেসে ফেলল। পরেশও। মদন রেগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পুষ্প উঠে নিজের ঘরে ঢুকে দোর দিল।
গাজনের দিন। বিরাট ভিড়। মদনের পিঠ ডলে ডলে নরম করছে ভুলু কাকা। ওর মধ্যে দিয়েই মোটা লোহার হুক পরানো হবে। তারপর ঘুরবে। পাড়ার কয়েকটা বাচ্চাও তৈরি। তারাও মদনের আর বিমলের পিঠে চড়ে ঘুরবে। মালতী একটা উঁচু মাটির ঢিবির উপর বসে। পরেশ পাড়ার ছেলেগুলোর সাথে। মদ খেয়ে চুর। পুষ্প পাড়ার বৌদের সাথে পূজোতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর শুরু হল ঘোরা। আগে খুব ভয় করত মালতীর কিন্তু এখন করে না। বাচ্চাগুলো চীৎকার করছে। ঢোলের আওয়াজে গমগম করছে চারদিক। বেশ উত্তেজনা। হঠাৎ কি হল, মদন দড়ি ছিঁড়ে ছিটকে পড়ল বোসেদের পুকুরে। হইচই বেধে গেল। পুষ্প থতমত খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। সকাল থেকে না খাওয়া। পাড়ার ছেলেরা পুকুরে নেমে গেল। মদনকে যখন তোলা হল সে মৃত। পুষ্প মাঝেমাঝেই অজ্ঞান হচ্ছে। জ্ঞান ফিরতেই বলছে, আমি বলেছিলাম, মাংস খেও না, খেও না, বাবা সহ্য করবেন না...
পুষ্পকে পাওয়া গেল না পরের দিন। মালতী বেশি খোঁজার চেষ্টাও করল না। পরেশও না। তারা জানত পুষ্প আর পারছিল না এখানে থাকতে। তার বয়েস হয়েছে। পাড়ার লোকেদের সাথে মেশামেশিও নেই। তারা এড়িয়ে চলে পুষ্পকে। তাও মদন ছিল তো তার একটা জোর ছিল মাথা উঁচু করে বাঁচার। বিধবা বেশ্যার আর কি মান সমাজে?
এরপরে ঘটনা বিশেষ কিছু নেই। পরেশ পুণে চলে গেল। সেখানে তার বন্ধু তাকে কিছু একটা কাজ জুটিয়ে দেবে বলেছে। মালতী ধাবা থেকে বড় হোটেল, হোটেল থেকে বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থায় বড় বড় ক্লায়েন্ট পেতে লাগল। মাঝে সে একটা স্পোকেন ইংলিশ কোর্সও করেছে কাজে সুবিধা হবে বলে।
বেশ কয়েক বছর পর মালতী একবার তার মা'কে দেখেছিল হরিদ্বারে। প্রথমটায় চিনতে পারেনি। একটা ছেঁড়া শাড়ি পরা শীর্ণ মহিলা। মাথা খারাপ বোঝা যাচ্ছে। তাদের হোটেলের সামনের একটা ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজছিল। মালতী সদ্য দুপুরের খাওয়া সেরে ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল রোদ পোহাবে বলে। জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি তখন। মালতী প্রথমটায় চিনতে পারেনি। পরক্ষণেই চিনতে পারে। তার মাথা থেকে পা অবধি একটা শিহরণ খেলে যায়। মালতী কিছু বলতে পারেনি। এক বুড়ো মাড়োয়াড়ীর সাথে এসেছিল। অঢেল টাকা। এখন সে এই বুড়োরই কেনা মেয়েমানুষ। বড়বাজারে একটা বাড়িতে থাকে। পরে তাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দেবে বলেছে। মালতীর সাথে একবার চোখাচোখি হয়ে যায় তার মায়ের। পুষ্প ভুরু কুঁচকে তাকায়। মালতী ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে আসে। তারপর হোটেলের বয়কে ডেকে কিছু খাবারের প্যাকেট ওই পাগলীকে দিয়ে আসতে বলে। তার চোখের কোলে যে আর্দ্রতা তা সে বহুদিনের অভ্যাসে আড়াল করে নেয়। বেশ্যার কান্নায় অমঙ্গল হয়।