অভ্যাসের জড়ত্বে টিপ ছাপ দিয়ে অলস মস্তিষ্ক ঘুমাচ্ছিল। জগতে যা কিছু পরিবর্তন তাকে তার বাড়াবাড়ি মনে হয়। যা আছে সেই ঢের। আবার এত কিসের নড়চড়া, পরীক্ষানিরীক্ষা।
এর মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল দেশে নাকি বড়সড় গোল বেধেছে। ধর্ম নাগরিকত্ব নিয়ে। অলস মস্তিষ্ক ভালো করে চাদ্দিক তাকিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল কোন দিকে গেলে গালাগাল কম খেতে হবে, পপুলিজমের খেল কোন দিকে? দেখল সোশ্যাল মিডিয়ায় হাওয়া কোন দিকে। অলস মস্তিষ্ক হাওয়া বুঝে নিজের দিক নির্ধারণ করে নিশ্চিন্তে গা ঝাড়া দিয়ে শুলো। কি ধরণের পোস্টে লাইক, শেয়ার করতে হবে এখন তো সব ফর্মুলা। কি সব পোস্টে গালাগাল, রাগ প্রদর্শন করতে হবে তাও জানা। আধবোজা চোখে কাজ চালিয়ে যেতে যেতে, হাই তুলতে তুলতে যথা সম্ভব সঠিক নির্বাচন চালিয়ে যেতে লাগল।
টুক করে ইন্টারনেটের কানেকশন গেল বন্ধ হয়ে। এইবার! অলস মস্তিষ্ক পড়ল মহাবিপদে। যেন ঘর ভর্তি বানানো কাগজের নৌকা, এদিকে নালির জল বন্ধ, ভাসাবে কোথায়?
বই নিয়ে বসে। মন লাগে না। টিভি চালিয়ে নিউজ দেখে, আরো উত্তপ্ত হয়, আরে কতগুলো বিষয় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে হবে, কি নিয়ে কার পক্ষে কার বিপক্ষে বলতে হবে সব রেডি, কিন্তু শালার নেটটাই অফ।
কয়েকজন সংখ্যালঘু মানুষের মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। কি বলবে তাদের গিয়ে? মনে মনে কয়েকটা নাটকীয় দৃশ্য তৈরি করে ফেলল। মনে মনে জাতীয় সংহতির দুর্দান্ত কিছু ক্লাইম্যাক্স তৈরি করে, নিজেকে হিরো বানিয়ে, নিজেই নিজের চোখের জলে ভেসে, হৃৎপিণ্ডের গতি ট্র্যাকিকার্ডিয়ায় ছুটিয়ে, চোখ মেলে দেখল, চারদিকে চারটে দেওয়াল, ঘড়িটা টিকটিক করছে, টিউবলাইটের ধারে চেনা টিকটিকিটা পোকার আশায় বসে, চায়ের কাপে ভালো করে না ছাঁকা তলানি জমে, চোখের কোল জলে ভিজে শীত শীত করছে।
অলস মস্তিষ্ক আবার নেট অন করতে চাইল, হল না। কয়েকজন সমমেরুর বন্ধুকে কল করে নিজের আবেগজ্বালা মতামত বলতে গেল, জমল না। সবাই মিলে নেট বন্ধের অসুবিধা নিয়ে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। নানা বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। আজানের শব্দ নেই কেন? আসলে এদিকে তো মসজিদ নেই, আচ্ছা দিনে কটা আজান হয়? আজান মানে কি? কবার নামাজ পড়া হয়? কোরাণে কটা অধ্যায়? কি লেখা আছে?
কিচ্ছু জানা যাবে না এখন, নেট অফ। আগে জানা হয়নি কেন? অলস মস্তিষ্কের কান্না পাচ্ছে, ক্ষোভ হচ্ছে। কেন সে এখন বুড়ো? কেন সে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নয়? তবে তো সে মিছিলে যেতে পারত? এখনও গেলে হয়, কিন্তু কে চিনবে তাকে? সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিল কেন তখন কোনো আন্দোলন হয়নি? ভাগ্য! সবটাই ভাগ্য। কেমন ম্যাড়মেড়ে জীবন একটা, না! অসহ্য!. আচ্ছা তার সময়ে যারা আন্দোলন করত, মানে ছোটোখাটো আন্দোলন করত, তারা কেউ সক্রিয় রাজনীতি কেন করল না পরের জীবনে? সে নিজেও তো কত বৈপ্লবিক চিন্তা করেছে, একবার রিজার্ভেশানের বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধান পুড়িয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছে। তারপর কি হল? চাকরি। এখনও সেই চাকরি। সেই দেওয়াল। সেই ডেস্ক। সেই একই সরকারি কর্তব্য সমাধা করে যাচ্ছে খাতায় কলমে, গতি নেই, বৈচিত্র্য নেই। মাইনে আছে। নিশ্চয়তা আছে। শান্তি আছে। সুখ আছে। বিপ্লব কই?
অলস মস্তিষ্ক উপুড় হয়ে শুয়ে। নেট অফ। নেটফ্লিক্স অফ। হোয়াটস অ্যাপ অফ। টিকটক অফ। হটস্টার অফ। সব অফ! বাড়াবাড়ি। রাগ হচ্ছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। পুরো ছুটির দিনটা বেকার। বেড়াতে যাওয়া ছিল। রুম বুক ছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে তিনদিনের অবকাশ, সব জলে গেল। ট্রেন ক্যান্সেল। অসহ্য! প্রচণ্ড রাগ! ক্ষোভ! যন্ত্রণা! এমনকি টাইমলাইনও স্তব্ধ। নেট অফ। বিপ্লব অফ। নাগরিক চেতনা অফ। নৈর্ব্যক্তিক সত্তা অফ। সব ম্যাড়মেড়ে।
অলস মস্তিষ্ক ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। তার কত কমেন্টস করার ছিল, কত মানুষকে নিয়ে খিল্লি করার ছিল, কত নিউজের তলায় হাড় জ্বালিয়ে দেওয়া বাক্য লেখার ছিল - সব তৈরি হয়ে মাথার মধ্যে বসে, কাগজের নৌকোরা... জল ছাড়ো.. ওগো জল ছাড়ো......
বন্ধ বইয়ের পাতারা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন জাগায়। "ওরে আয়, পড় দু'পাতা, গভীরে ভাব, তলিয়ে দেখ, খোল আমায়, পাতা ওল্টা, আমি ইতিহাস নিয়ে বসে আছি"...
অলস মস্তিষ্ক ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে ওঠে... দূর হও... দূর হয়ে যাও আর্বান নক্সালেরা...., দূর হয়ে যাও ভক্তেরা... দূর হয়ে যাও সব... সব ঝুট হ্যায়.... ঝুট হ্যায়.... দাও ফিরে সে ইন্টারনেট, লও এ বাস্তব..
সৌরভ ভট্টাচার্য
27 December 2019