আমি ঈশ্বরকেও আমার প্রয়োজনের মধ্যে টানতে নারাজ। সরে যাও। দেখো আমি না পারলেও ঠিক মানিয়ে নেব। যেমন আকাশের সঙ্গে মানিয়ে নেয় মাটি; রোদ, বৃষ্টির সমঝোতায়। কি হবে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলে। আমার অত সময় কোথায়?
সেদিন আমি বাজারের দিকে যাচ্ছি। রেললাইনের নীচ দিয়ে যে রাস্তাটা, যেখানে আগে জল জমে থাকত, ঠিক সেইখানে গিয়ে আমার সাইকেলটার পিছনের চাকাটা গেল লিক হয়ে। সকালবেলা, চারদিকে কি ব্যস্ততা। সবাই যেন সোনার খনির খবর পেয়েছে। কি দৌড়াদৌড়ি। কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। গাড়ির হর্ন, মানুষের চীৎকার, সব মিলেমিশে কি একটা যেন হচ্ছে। সবাই সবাইকে ঠেলে সামনের দিকে এগোতে চায়, সামনে যেন সোনার খনি আছে। কিসে সুখ পায় মানুষ? দুঃখকে ভুলে থাকাতেই তো সুখ। ব্যস্ততা কি দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়?
আমিও তো ব্যস্ত ছিলাম। এই খানিক আগে অবধি আমি আমার আসন্ন সুখের কল্পনায় মশগুল হয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কে জানত হঠাৎ এমন কিছু হবে? তাও এমন ব্যস্ত পুলের তলায়। যেখানে চারদিকে ছুটছে মানুষ, আর মাথার উপর দিয়ে লোহার উপর দিয়ে ছুটছে ট্রেন।
আমার ভীষণ লজ্জা, অস্বস্তি হচ্ছে তো। কেউ কি দেখছে? সবাই কি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে আমার এই বেহাল অবস্থা দেখে? কার চোখের দিকে তাকাব? মানুষের তো সহস্রচোখ। অক্টোপাসের আটটা হাত, বা পা কিছু একটা হবে। মানুষের তো আঁকড়াবার হাত হল চোখ। সহস্রাক্ষি মানুষ আঁকড়ে রাখতে চায় গোটা বিশ্বকে নিজের দৃষ্টির মুঠোতে। কিচ্ছু ছাড়তে চায় না। নগ্ন শরীর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র চূড়া, সমুদ্রের ফেনিল দিগন্ত থেকে বাড়ির আনাচকানাচ, সব দৃষ্টিতে মুঠোতে বন্ধ। ছেড়ে যেতে চায় না। আর যাবেই বা কেন? যাবে বলে তো সে আসেনি। এসেছে নিজেকে মুক্তো বানাতে। বাইরে থেকে যা কিছু পায়, সব জমিয়ে জড়ো করে সে একজন দ্রষ্টব্য, স্মরণব্য, ঈর্ষব্য কিছু হবে। তবেই যে না এই হাড়মাংসের শরীরে রক্তের আবর্তন সার্থক!
আমার চোখে চোখ রেখে রাস্তার পাশে ফুটপাতে আধশোয়া এক পাগল। অর্ধেক ল্যাংটো। গায়ে কিছু নেই। অত কালো তো মানুষ হয় না। ও ময়লা। চাপ চাপ ময়লা। চুলগুলো ঘাড়, কান বেয়ে নেমে এসেছে। যেন বটের ঝুরি। প্যান্টটা শতচ্ছিন্ন। নারায়ণের মত কাত হয়ে শুয়ে, এক হাতে পাগল মাথাটাকে ভর দিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই কি তোমার ক্ষীরোদসাগর পাগল! এইখানে হবে সমুদ্রমন্থন! অমৃতকলস পেলে পাগল? লক্ষ্মী কই তোমার?
পাগল শুয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি লিক সাইকেলটা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার দিকে সহস্রচোখ। সে চোখ বিষ। পাগলের চোখে কৌতুক। পাগল হাসছে আমায় দেখে। তার একগাল দাড়ি, মুখের মধ্যে ঢুকে পড়া গোঁফ, সব নোংরা। তবু হাসছে। সে হাসিতে মধু। পাগল আমি সমুদ্র মন্থন করব। এ জগত মন্থন করছি। আয়ু আমার বাসুকি। একদিকে আমার বিবেক, আরেক দিকে আমার লোভ। ঐরাবত উঠেছে। উচ্চৈঃশ্রবাঃ উঠেছে। উঠেছে পারিজাত। অমৃতকলস। আমি সে সব ফিরিয়ে দিয়েছি। চাইনি কিছু। এমনকি অমৃতকলসও না। দেবতা অসুরের দ্বন্দ্বে আমি নেই। সে সব অলীক পাগল। আমি থামছি না। বিষের পর বিষ উঠে আসছে। আমি শুধু বিষের উৎস খুঁজছি। এত বিষ, এত বিষ পাগল! তুমি কি ওতেই পাগল হলে? জগতজোড়া পাগল! সব কি ওতেই পাগল হল!
সাইকেলের দোকানে ভিড়। লিক সাইকেল দেখে সাইকেল সারানোর কারিগর বলল, "বসতে হবে। লোক আছে অনেক।"
একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে আছি। পাশে রাখা অনেকের বারবার পড়া খবরের কাগজ। মন্থনের খবর। বিষের খবর। তুমি এখনও তাকিয়ে আছ। তোমার তাকিয়ে থাকায় আমার ভিতরে এমন স্বস্তি জাগছে কেন বলতে পারো? তুমি কি সব বিষ ধারণ করে আছ? তুমিই কি সেই? দেবাদিদেব? বিষ ধারণ পাগল ছাড়া কে করবে দেবাদিদেব! তাই সব সৃষ্টিপাগল মানুষ কি এমন সৃষ্টিছাড়া! জগতে সব সুর, সব রঙ, সব কাব্য জন্মেছে পাগলের হাতে! তাই কি? সব সৃষ্টির মূল তুমি। দেবাদিদেব তুমি! নটরাজ তুমি। কবি তুমি। শিল্পী তুমি। গায়ক তুমি। সুরস্রষ্টা তুমি। তুমি পাগল। তুমি মহাদেব। তুমি দেবাদিদেব।
পাগল, আমার সাইকেল ঠিক হয়ে গেছে। আবার আমার চোখে নামছে আবরণ। ব্যস্ততার আবরণ। নিজেকে ধনী-মানী করার আবরণ। আবার আমি বিষণ্ণতার ছেঁড়াপাতা হব কি পাগল! আমায় বিষ ধারণ করা শেখাও পাগল! পায়ে পড়ি তোমার। আমায় বিষ ধারণ করার শক্তি দাও, আমায় আশীর্বাদ করো। আমার অমৃত চাই না, চাই না আমার সসাগরা সুখ, বিলাস, মান। আমায় তুমি তোমার চেলা বানাও। দাও আমায় বিষ ধারণের ব্রত। আমি পাগল হই। আমি সার্থক হই পাগল। আমার প্রণাম স্বীকার করো পাগল। আমায় চেলা করো।