সৌরভ ভট্টাচার্য
29 April 2018
আমি একটা অদৃশ্য ঘর বানিয়েছি। তার চারদিকে ঘন জঙ্গল। কেউ পথ চিনে আসতে পারে না আমি চিনিয়ে না আনলে। সেই জঙ্গলের বাইরে, বড় রাস্তার ধারে কয়েকটা মিছিমিছি ঘরও বানিয়েছি। যেই কেউ প্রশ্ন করে কোথায় থাকো? আমি ওই মিছিমিছি ঘরগুলোকে দেখিয়ে বলি, এই তো, সোমবার এটায়, মঙ্গলবার ওটায়...আর রবিবার ওটায়, তারপর আবার সোমবার এটায়। কেউ কেউ বাইরে থেকে ঘর দেখে ফিরে যায়, কেউ কেউ ঘরের ভিতর এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কিন্তু বুঝতে পারে না ওটা নকল ঘর। কারণ ঘরটা নকল হলেও, আমার আপ্যায়নটা তো আর নকল নয়!
সবাই ফিরে গেলে আমি সেই একলা ঘরে, জঙ্গলের মধ্যের সেই আসল ঘরে একলা ফিরে আসি। হাত-মুখ ধুয়ে, বাইরের কাপড় জামা ছেড়ে শুদ্ধ পরিষ্কার হয়ে খাটের উপর এসে বসি। এই ঘরে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ কিন্তু আমার খিদে, তেষ্টা ইত্যাদি স্থূল কোনো কিছুর দাবী শরীর জানায় না। ওগুলোর সাথে বোঝাপড়া জঙ্গলের বাইরেই সেরে আসি।
জঙ্গলের মাথায় পাক্ষিক চাঁদ ওঠে, আবার অমাবস্যাও হয়। ঝড়বৃষ্টি, গ্রীষ্ম-বর্ষা সবই হয়। আমার কাজ শুধু জানলার ধারে বসে থাকা। জাগতিক জঙ্গলের সাথে পার্থক্য হল, এই জঙ্গলে সবাই কথা বলতে পারে। একটা ভাষাতেই কথা বলে। সে ভাষার যদিও কোনো নাম নেই। এরা কেউ নামে বিশ্বাস করে না। আর সবাই সব সময় কথাও বলে না এরা। যার যখন কথা বলার সে তখনই কথা বলে, যতটা দরকার ততটাই বলে। এখানে কেউ বিরক্ত হয় না। কুয়াশা থাকে যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কিম্বা বৃষ্টি চলছে মাসের পর মাস, কেউ বিরক্ত হয় না। এখানে আসলে সময় বলে কিছু নেই। এখানে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম বলেও কিছু নেই। যার যখন যেদিকে যাওয়ার দরকার, সে সেদিকেই যায়, কেউ বারণ করে না, আবার যখন সে ফিরে আসে, সে কোথায় গিয়েছিল কেউ প্রশ্নও করে না।
এখানে কোনো ধর্ম নেই, কোনো ঈশ্বর নেই। কারণ এখানে কারোর কোনো সংশয় নেই। ঈশ্বর তো থাকে সংশয়ীর। যার অনুভব আছে সে তো কোনো সংজ্ঞায় থাকে না। যে গান শিখছে তার কাছে মল্লার বলে একটা রাগ আছে। যে মল্লারে সিদ্ধ সে তো আর মল্লারকে খুঁজে পায় না। লোকে তার মধ্যে মল্লারকে পায় খুঁজে। তাই এখানে কোনো ঈশ্বর নেই। এখানে কারোর মনে কোনো সংশয় নেই। যেহেতু সংশয় নেই, তাই কারোর কোনো ধর্মও নেই। কারণ ধর্ম মানে তো অধর্মের সীমারেখা। এখানে কোনো অধর্ম নেই, তাই সে সীমারেখা টানার প্রয়োজনও নেই। যেহেতু কোনো ধর্ম নেই, তাই কোনো বিভাজনও নেই একের সাথে অন্যের। আসলে এখানে ‘অন্য’ বলে কোনো শব্দই হয় না।
যেহেতু এখানে ‘অন্য’ বলে কোনো শব্দ হয় না। তাই এখানে ভয় বলে কোনো অনুভব হয় না। গাছের শিকড় যেমন তার শাখার আন্দোলনকে ভয় পায় না, তেমনই এখানে কেউ কাউকে ভয় পায় না। এমনকি তুমুল ঝড়েও ওঠে গান। ভূমিকম্পতে বেজে ওঠে মাদল। অগ্ন্যুৎপাতে আকাশে বাজে দীপক রাগ চিলেদের কণ্ঠে। এখানে কেউ ধ্বংসে বিশ্বাস করে না। কারণ এখানে সবাই জানে সে অনেকের সমষ্টি। একা বলে কিছু হয় না। এক বলে হয়। অনেকে মিলে যে এক – সেই তার শরীর। তাই মৃত্যু বলতে এখানে বোঝায় অনেকের একে প্রত্যাবর্তন। যেমন পাহাড় ভেঙে হয় পাথর। পাথর ভেঙে হয় মাটি। মাটিকে ভাঙা যায় না। কারণ মাটি আগুনের মত মৌলিক। মাটি ভালোবাসার মত স্বাধীন। মেঘ বৃষ্টি হতে ভয় পায় না। জল মেঘ হতে ভয় পায় না। জীবন মৃত্যুর সাথে সাঁতার কাটে বারোমাস এখানে। কখনও এ দেয় ডুব সাঁতার, ও গিয়ে তাকে তোলে। কখনও এর ঘাড়ে চড়ে এ আসে এ পারে, কখনও ওর ঘাড়ে চড়ে ও যায় ওপারে। মৃত্যু হাঁপালে জীবন এগিয়ে আসে, জীবন হাঁপালে মৃত্যু ধরে হাল। ওরা বলে এটাই স্রোত। কখনও ঢেউয়ের চড়াই, কখনও ঢেউয়ের উতরাই।
আসলে কেউ আসতেই চায় না এ জঙ্গলে। আমি যাকেই আনতে চাই সেই বাঁধে পোঁটলা। পোঁটলার মধ্যে বাঁধে ঘড়ি, নানারকম ঠাকুরদেবতা, নানারকম ধর্ম, নানারকম হিসাবনিকাশের খাতা, কতরকম ভয়, কতরকম প্রেম (আমি ওগুলো হাতে নিয়ে দেখেছি সূর্যের আলোয় ভালো করে, আতসকাঁচ দিয়ে, ওগুলো প্রেমের মত দেখতে, কিন্তু প্রেম নয়। ওগুলো দাঁতনের মত কাঠি। চিবিয়ে, রস নিয়ে, একঘেয়েমি মেজে ছিবড়ে করে ফেলে দেয়। কিছু দাঁতন নুন-তেল মাখানো ঝাঁঝালোও তো হয়। ওগুলো দিয়ে মাজতে মাজতে লালাগ্রন্থি যায় জ্বলে, টসটস করে গড়ায় রস। যত ঝাঁঝিয়ে ওঠে তত ওরা ওঠে নেচে, যতক্ষণ না জিভ যায় হেজে। আসলে ওগুলো প্রেম নয়, ওগুলো দাঁতন।)। আমি বলি ওগুলো ফেলে এসো। ওরা তর্ক বাধায়। খিমচাখিমচি করে। বলে ছাড়ব না। আমার পিছনে পিছনে আসে। পোঁটলা থাকলে জঙ্গলে পথ হারাতে হয়। পোঁটলায় থাকে মন। ফলে আমলকি গাছকে মনে করে হরিতকি গাজ। আমগাছকে মনে করে কাঁঠালগাছ। বাদুড়কে ভাবে বাজপাখি। সাপকে ভাবে বেজি আর ময়ূরকে ভাবে গণ্ডার। চোরাবালিকে ভাবে মোহনা, আর চড়াই পথকে ভাবে পাগলা হাতি। ব্যস। হারিয়ে যায় জঙ্গলে। আমি তাই একলা একলাই থাকি। তবু একলা একলা লাগে না তো। এখানে সবাই মিলে এক।
এখানে যারা থাকে না তাদের সবার ছায়াই ভাসে। তারা জানে না। তারা নিজেদের ছায়াটা কতবার চেয়েছে আমার মুখে শুনে। আমি বলেছি রাখবে কোথায়? আমি তো দিতেই পারি এনে।