নরহরিবাবু প্রায় তিরিশ বছর হল ইছাপুর থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করছেন।ইদানীং একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। উনি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছেন না, ঠিক কি হচ্ছে।
উনি বাড়ি ফেরেন প্রায় রাত আটটার কাছাকাছি। স্টেশানে নেমেই কোনো একজন অপরিচিত মানুষের সাথে উনি কোনো পরিচিত মুখের আদল পান। শুধু তাই না, সেই পরিচিত মানুষের সাথে নরহরিবাবুর দেখা হবেই, সেদিন না হলে পরের দিন তো অবশ্যই।
এই তো গত পরশু। স্টেশান থেকে নেমেই যে চায়ের দোকানটা, বিশুর চায়ের দোকান। ছেলেটাকে দেখে আসছেন তা প্রায় বছর দশেক হল। সেদিন হঠাৎ নরহরিবাবুর মনে হল, আরে অনেকটা তার ভায়ের মুখের মত না!
বাড়ি ফিরেই দেখেন ওনার ভাই রামহরি খড়গপুর থেকে এসে হাজির। আরেকদিন ফুলওয়ালা মাসির সাথে ওনার শালীর শাশুড়ির মিল পেলেন। তিনিও এসে হাজির! এখানে নাকি ওনাদের কোন বিয়েবাড়ি ছিল, তাই দেখা করতে এসেছেন, বোঝো একবার! এরকমভাবে কাকা, মামা, শালা, শালী, বহু পুরোনো বন্ধু- পালা করে কত লোকের সাথে দেখা হতে শুরু করেছে।
মাঝে মাঝে বিরামও হয় ঘটনাটার। তবে হিসাব করে দেখেছেন সপ্তাহে তিনটের বেশি হয় না।
কাউকে মন খুলে কথাটা বলতেও পারছেন না। ক্লাবে যান রোজ একঘণ্টা করে ক্যারাম খেলতে। কয়েকজন বন্ধুকে বলবার চেষ্টাও করেছেন। তারা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। নিজের স্ত্রী সুশ্রীকে বলার কথাও ভেবেছেন। তা সে খুব ভীতু বলে আর বলে উঠতে পারেন নি। 'কাকতালীয়' ভেবে ঝেড়েও ফেলতে পারছেন না। এতবার কাকতালীয় হয় নাকি!
অবশ্য এখন মাঝে মাঝে বেশ ভালই লাগছে ব্যাপারটা। সেদিন খুব মজা হল। একজন গামছাওয়ালাকে দেখেই তাঁর মনে হল, আরে আমার মত দেখতে না! সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছেন, আজ তাহলে কে আসবে, তাঁর নিজের যমজ ভাই আছে বলে তো শোনেন নি।
বাড়ি ফিরে চা-টা খেয়ে আর ক্লাবে গেলেন না। মনটা খুব ছটফট করছে। যা হোক টিভিতে নিউজ দেখতে শুরু করেছেন অস্থিরতা কাটানোর জন্য। এমন সময় একটা ছেলে এল ২২/২৩ বছরের হবে। ওনার কাছে অ্যাটেস্টেড করাবে। হুবহু ওনার কলেজ জীবনের মুখ কেটে বসানো! উনি অবাক, ওনার স্ত্রী অবাক! ছেলেটা অপ্রস্তুত। কি কান্ড!
সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছে। ট্রেন থেকে নেমেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাতেই নরহরিববাবুর মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত শিহরণ খেলে গেল। এ যে পুরো ওনার বাবার মুখ! তা কি করে হয়! উনি তো আজ ১৫ বছর হল মারা গেছেন। মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে ওনার। একটা ঘোরের মধ্যেই বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন।
ফিরে দেখেন বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেউ নেই, বাইরে তালা দেওয়া। ওনার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে, তালা খুলে ঢুকলেন। কোথায় গেল সব? আর গেলে তো বলেই যায়! মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। পুরো ভিজে গেছেন। এখনই স্নান না করে নিলে জ্বর চলে আসবে। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেলেন। স্নান সেরে গা মুছতে গিয়ে দেখেন টাওয়েলটা আনতে ভুলে গেছেন। বাথরুমের দরজাটা যেই খুলেছেন, দেখেন টাওয়েল হাতে ওনার বাবা দাঁড়িয়ে - প্রাণকেষ্টবাবু।
নরহরিবাবুর বাড়ির লোকের কাছে থানা থেকে ফোনটা এসেছিল নরহরিবাবু বাড়ি ঢোকার আধঘণ্টা আগেই। স্টেশান থেকে বেরিয়েই ওনার ম্যাসিভ হার্ট অ্যটাক হয়। স্পট ডেড।
(ছবিঃ সুমন দাস)