আর সামাজিক চিন্তা করবেন না। তাই মহেশ্বরবাবু ঠিক করেছেন কয়েকটা দিন কোনো ভূতুড়ে বাড়িতেই কাটিয়ে আসবেন। অনেক খোঁজপাতি করে শেষে রাণাঘাটের থেকে চোদ্দো মাইল দূরে হাড়জোড়া গ্রামের কোনায় একটা ভূতুড়ে বাড়ির সন্ধান পেলেন। একদিন বেলায় চাট্টি ডালভাত খেয়ে, একটা ট্রলিতে জামাকাপড় ভরে রওনা দিলেন। হাওড়া থেকে ব্যাণ্ডেল হয়ে নৈহাটি, তারপর রাণাঘাট লোকাল ধরে রাণাঘাটে যখন নামলেন তখন বিকাল। তারপর বাসে, ভ্যানে করে যখন সেই ভূতুড়ে বাড়িটায় পৌঁছালেন, তখন সন্ধ্যে হয় হয়। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েই আবেগে মহেশ্বরবাবুর চোখে জল এলো, মনে হল এমন একটা বাড়ি ভূত না থেকে পারে? মহেশ্বরবাবুর রোগাটে কাঁচাপাকা মাথার মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। মনে হল কারা যেন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু একটু পরেই বুঝলেন এ সবই তার মনের খেয়াল। একটা সিগারেট ধরিয়ে মাঠের মধ্যেই বসলেন। তিপান্ন বছর বয়স হল, কিন্তু তোমার ছেলেমানুষীটা আর গেল না, মহেশ্বরবাবুর স্ত্রী, হেডমিস্ট্রেস খোকাবালাদেবী, তাকে বেরোবার সময় এই কথাটা বলেছেন। কথাটা মনে পড়তেই মহেশ্বরবাবুর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল, জীবনটা এতটা গড়িয়ে এলো অথচ একটা আজও ভূত দর্শন হল না? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সিগারেটের টুকরোটা মাটিতে ছুঁড়ে, রুমালে হাত মুছে, সদর দরজাটার কাছে এসে দাঁড়ালেন। এ বাড়ির বয়েস নাকি প্রায় পাঁচশো, আগে দূর্গাপূজো হত, কিন্তু কি এক মড়কে এই গ্রামের প্রায় সবাই মারা যায় আর নাতো গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, সেই থেকে পূজো বন্ধ। তারপর অনেকে এ বাড়ি কিনতে চেয়েছে, কিন্তু কোনো না কোনো অঘটন যারাই কিনতে গেছে তাদের সাথে নাকি হয়েছে, কেউ মারা গেছে, কেউ জেতা কেস হেরেছে, কেউ হাত-পা ভেঙে জম্মের মত নাকি পড়ে আছে।
সদর দরজাটায় একটা ধাক্কা দিলেন, ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়ে দরজাটা খুলে গেল। ভিতরটা ভীষণ জঙ্গল। মহেশ্বরবাবু টর্চটা জ্বেলে, নিজের গায়ের খোলা জায়গাগুলো ওডোমস মেখে নিলেন। তারপর পা টিপে টিপে এগোতে যাবেন, হঠাৎ ধুম করে আওয়াজ হয়ে পিছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। মহেশ্বরবাবু চমকে উঠে পিছন দিকে তাকালেন, কেউ নেই, অন্ধকার হয়ে গেছে ভালোই। সামনে একটা টানা বারান্দা, মোট ছ'টা ঘর, সবক’টাই বন্ধ, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা যায়, উপরে তিনটে ঘর নীচ থেকে আগেই দেখে নিয়েছেন। তিনি বারান্দায় উঠে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিকে এগোলেন। হঠাৎ মনে হল কে যেন একটা ঠিক ওনার পিছন পিছন আসছে, হুট্ করে থেমে পিছন দিক ফিরলেন, আশ্চর্য হয়ে গেলেন, দরজাটা খোলা, বাইরে মাঠটা দেখা যাচ্ছে, দূরে দূরে বাড়িগুলোর আলো, কিন্তু কখন খুলল দরজাটা? যা হোক, সিঁড়িতে উঠতে শুরু করলেন, প্রচুর জঙ্গল হয়ে আছে, সাথে কার্বলিক আছে অবশ্য, উপরে গিয়ে ছড়াবেন, এখন না, মুখে ঝুল আটকে যেতে লাগল, কিন্তু কয়েক ধাপ উঠতেই মনে হল এবার যেন সামনে কেউ একটা দাঁড়িয়ে, সারা গা দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল, সামনে একটু উঁচু করে আলো ফেলতে যাবেন, হঠাৎ পিছন থেকে একটা কেউ তার পিঠে হাত রেখে বলল, এগিয়ে চলুন পিছনে তাকাবেন না। এসেই যখন পড়েছেন, অনেকদিন তো এবাড়িতে কেউ আসে না। মহেশ্বরবাবু জানেন এ সব পোড়ো বাড়িতে প্রচুর অসামাজিক লোক খারাপ কাজ করতে আস্তানা গাড়ে। তিনি তাই কিচ্ছু ভয় না পেয়ে বললেন, আপনি কে? ভূত তো নন বোঝাই যাচ্ছে।
পিছনের সেই কণ্ঠস্বর বলল, বাবা, খুব আত্মবিশ্বাস দেখছি? তা ভূত নাতো কে বলুন তো? মহেশ্বরবাবু বললেন, আপনিই বলুন? সেই কণ্ঠস্বর বলল, উপরে চল, বলছি। বলেই সে চুপ, মহেশ্বরবাবু সট করে পিছনে ঘুরে দেখেন সদর দরজাটা আবার বন্ধ মনে হচ্ছে, কারণ আলোগুলো তো দেখা যাচ্ছে না।
উপরে পর পর তিনটে ঘর। দুটোর মধ্যে একটার অবস্থা একটু ভালো, সেই ঘরটাতে ঢুকে মহেশ্বরবাবু একটা মোমবাতি জ্বাললেন। কার্বলিক ছড়ালেন। একটা মাদুর পেতে বসলেন। উপরের কড়িবর্গাগুলোতে ঝুল আর ঝুল। জানলা রয়েছে দুটো, উঠে গিয়ে খোলার চেষ্টা করতেই একটার পাল্লা ভেঙে নীচে পড়ে গেল, আরেকটা পাল্লা অর্ধেক ভেঙে ঝুলতে লাগল। মহেশ্বরবাবু আবার এসে বসলেন। ফ্লাক্সে চা আছে, একটা কাপে ঢালতে যাবেন, হঠাৎ একটা খড়খড় আওয়াজ করে একটা নারকেলে মালা তার সামনে এসে পড়ল। বেশ বোঝা যাচ্ছে কেউ ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আনছে, কিন্তু কে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তার চায়ের কাপের কাছে নারকেলের মালাটা এসে ঠেকল। মহেশ্বরবাবুর কি মনে হল একটু চা ঢাললেন, অমনি সুড়ুৎ করে কেউ টেনে নিল, আবার ঢাললেন, আবার সুড়ুৎ করে কেউ টেনে নিল। আবার ঢালতে যাবেন, কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠল, থাক! মহেশ্বরবাবু নিজের অজান্তের, বেশ বলে ঢাকনাটা বন্ধ করতে যাবেন, হঠাৎ কোথা থেকে একটা ঝুললাগা কাপ এসে তার কাপের পাশে বসল। তিনি আবার চা ঢাললেন, ঢালতে ঢালতে দেখলেন এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার কঙ্কালসার শরীর তার সামনে বসে। তার দিকে তাকিয়ে।
বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ভয় পেয়ো না বাবা, আমরা ভূত, তবে খুনে ভূত নই, ক্ষুধার্ত ভূত। বৃদ্ধা খ্যানখেনে গলায় বলে উঠলেন, তা উনি যা বলেছেন সত্যিই বাবা, তোমার সাথে যে পরোটা আলুভাজা আছে আমরা একটু আগেই খেয়েচি, বেশ ভালো হাত খোকাবালার, তা হবেনি কেন, সে তো আমার নাতির মেয়ের নাতির মেয়ের
নাতির জামাইয়ের মেয়ের মেয়ে গো! বৃদ্ধ হাসলেন। মহেশ্বরবাবুর মাথাটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, এই রকম হলে মহেশ্বরবাবু শান্ত থাকার চেষ্টা করেন, এখনও করছেন।
- তা বুঝলে মহেশ, তোমার বিয়ের সময় আমাদের তো দেখোনি, তুমি হলে আমার খুব কাছের বন্ধু সুরেশের বংশধর, তুমি চিনবে না। তোমার বিয়ের সময় আমরা সবাই গিয়েছলাম। তোমাদের এক নৌকা রসোগোল্লা হাপিশ হয়েছিল মনে আছে, সে তোমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার তার বাবার বড়শালার কীর্তি, ওই তোমায় উপরে উঠিয়ে দিয়ে গেল। আসলে নীচের তিন নম্বর ঘরে একটা স্কন্ধকাটা আছে, লাইনে কাটা পড়েছিল, সে বড় উগ্র মেজাজের, কতজনকে যে তোমাদের লোক থেকে আমাদের লোকে নিয়ে এসেছে তার ঠিক নেই। এই ঘাড় মুচড়ে দেয়, এই বিকটরূপ ধরে তাদের হৃৎযন্ত্রের ছুটি করিয়ে দেয়, আর বোলো না বাবা, যা অশান্তি ওকে নিয়ে না, পারা যায় না।
মহেশ্বরবাবু এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, আপনারা জানতেন আমি আসব?
বৃদ্ধ বলল, হ্যাঁ তো, তোমায় যে ফোন করে খবর দিল, ওতো তোমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বড় ভাই। এখানে একটা লোকের পাব্লিক বুথ আছে, সে আবার আফিং খেয়ে ঘুমায়, তার শরীরে ভর করেই তো সে কলটা করেছিল। আসলে আমাদের এই অবস্থায় আমরা বিদ্যুতের কাছে যেতে পারি না, রামনামে আমাদের কিছু হয় না এখন, ওতো অতি পাষণ্ডতেও নেয় আজকাল, কিন্তু আমরা বিদ্যুতটা সহ্য করতে পারি না। তুমি তোমার মোবাইলটা অফ্ করে দাও।
মহেশ্বর একটা মেসেজ করে খোকাবালাকে মোবাইলটা অফ করে দিল। হঠাৎ দেখে জানলার কাছে কার একটা শরীর দাঁড়িয়ে, মাথাটা নেই, তার দিকেই ফিরে তাকিয়ে।
বৃদ্ধা বললেন, ওকে গুরুত্ব দিয়ো না বাবা, ওর কথাই বলছিলাম, সারাদিন 'আচ্ছে দিন আয়েগে, আচ্ছে দিন আয়েগে' করে জ্বালিয়ে খেলে বাবা, তুমি ওর দিকে বেশি মন দিয়ো না, ঘাড়ে চেপে বসবে।
মহেশ্বরবাবু বললেন, তা আমায় ডেকেছিলেন কেন?
বৃদ্ধ একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, তুমি বলো।
বৃদ্ধা বললেন, আ মোলো, মরে ভূত হয়েও লজ্জা গেল না তোমার? আসলে হয়েছে কি, এ বছর দেবীপক্ষে উনি 'ব্রহ্মদৈত্যশ্রী' খেতাব পাচ্ছে, 'ভূতভূষণ'তো পেয়েইছেন গেলবার। কিন্ত সে বার অনেক গোলেমালে সবাইকে খবর দেওয়া হয়নি। এবার ওনার ইচ্ছা সব এইলোক, ওইলোকের আত্মীয়দের ডেকে উনি খাওয়াবেন। তা সে ব্যবস্থা তোমাকেই করে দিতে হবে বাবা। এই পাশের ঘরে একটা শাবল পাবে। তুমি ওটা নিয়ে নীচে গিয়ে ভোর হওয়ার আগেই, বাবলা গাছের ডানদিক বরাবর খুঁড়তে শুরু করবে। আরো কয়েকজনকে তোমার শরীরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেব, তুমি কয়েক ঘন্টাতেই একটা সোনা ভরতি ঘড়া পাবে, ওটা নিয়ে একটা ব্যবস্থা তোমায় করে দিতেই হবে। আর খাওয়ানোর কাজটা করবে কালীঘাটে, আলিমুদ্দিনেও করতে পারতে, ওদিকেও আমাদের এইলোকের লোক অনেক আছে, কিন্তু ওনার ইচ্ছা কালীঘাট মন্দিরের চত্বরেই করতে।
এর পরের ঘটনা হল, একদিন পরে মহেশ্বরবাবুর নিজের বাড়িতেই হুঁশ ফেরে। সব কথা খোকাবালাকে খুলে বলেন। ছাদের ঘরে সোনার ঘড়া পাওয়া যায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেগুলো টাকা করার ব্যবস্থা করা হয়। পাড়ার ক্লাবটা সাহায্য করেছিল অবশ্য, তাদের ক্লাবটা এখন এসি বসে গেছে দুটো। কালীঘাটে এত পরলোকের অতিথিরা এসেছিল যে অনেক ভক্ত একটা আঁশটে গন্ধও নাকি পেতে শুরু করেছিল। ভাগ্যিস, দেখতে পায়নি কেউ। সে সব অতিথিরা কথা দিয়েছে এ বছরের ভূত চতুর্দশীতে তারা সবাই হাওড়ার 'হেলাঞ্চেতলা ক্লাব'-এ একটা জলসা করবে, খোকাবালা রাঁধবে, চাঁদা দুইলোক থেকেই আসবে। আর সেই গ্রামের জমিটাও যাতে মহেশ্বর পায় সেই ব্যবস্থা করার কাজ শুরু হয়ে গেছে, অনেকেই নাকি জমি রেজেস্ট্রি অফিসে দিনের বেলায় ভূত দেখছে। সেই শুনে কারা আবার যেন হনুমান মন্দির করবে বলে লাফাচ্ছে, সেই নিয়ে আরেকটা গোল বাধবে বাধবে করছে, কিন্তু সে অন্য গল্প।
(ছবিঃ সুমন)