অবশেষে নিবারণ যখন স্কুলের মাস্টারির চাকরিটা নিল, তখন পড়িমরি ঠাকুমা আর সহ্য করতে না পেরে শয্যা নিলেন।
কারণটা ভেঙে বলি। নিবারণ ঘোষেদের ওঝা বংশ। শোনা যায় নিবারণদের কোনো এক পিতৃপুরুষ, চোল বংশের পুরোহিত ছিলেন। তার কানে কিছু সমস্যা ছিল। দীক্ষার সময় ঠিক মন্ত্র শুনতে পাননি। কিন্তু পরম নিষ্ঠা নিয়ে জপের জন্য শিবকে না পেলেও ভূতসিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকে নিবারণদের ভাগ্য ফিরে যায়। কি করে তারা ঘোষ হল আর এই বাংলায় এলো সেও এক ভৌতিক কাণ্ড। সে নিয়ে কারোর স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু শোনা যায় যে কোনো এক পূর্বনারী (পূর্বপুরুষ যদি হয় পূর্বনারী হতেই বা দোষ কি!) নাকি এক ব্রহ্মদৈত্যের সঙ্গে এ দেশে এসে ঘর বেঁধেছিলেন। সেই থেকেই তারা এই হুড়ুমকুণ্ড গ্রামে এসে আছেন। তারকেশ্বর থেকে বেশি দূরে নয় এ গ্রাম।
বর্তমানে নিবারণদের পরিবারে ভূতের সংখ্যা ভীষণ কম। হাতে গোনা চারটে হবে। তাও সবাই প্রায় অসুস্থ। যা জল হাওয়ার দূষণ, তারপর এই মোবাইলের টাওয়ারের জন্য ওদের মাথা রাতদিন ঝিঁঝিঁ করে। এত সুক্ষ্ম নেটওয়ার্ক। এরপর ফাইভ জি হলে নাকি ওরা বলে বলে অজ্ঞান হবে। জ্ঞান ফেরানোই দায় হবে। পড়িমরি ঠাকুমা এ সব নিয়ে অতটা ভাবিত ছিলেন না, যতটা মা-বাপ মরা এই নিবারণের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কি সুন্দর তন্ত্রটন্ত্র শিখে কোথায় আরো নতুন প্রজন্মের ভূতেদের এনে সংসারটা গোছাবে, তা না, স্কুলে গেলেন বাবু বিদ্যাদান করতে!
পড়িমরি ঠাকুমা শুয়ে আছেন, একটা পেত্নী মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। দুটো ভূত পায়ের কাছে বসে ঢুলছে। আর একটা মামদো ছাদে ঝুলে ঝুলে নামতা পড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ পড়িমরি ঠাকুমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অমনি যে ভূতদুটো ঢুলছিল তারা "হও ধরমেতে ধীর" গাইতে গাইতে খাটের চারপাশ ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। যে মামদোটা ছাদে ঝুলছিল সে হাতটা পাখার মত করে হাওয়া দিতে লাগল। আর যে পেত্নী বিলি কাটছিল সে পড়িমরি ঠাকুমার মাথায় জোরে জোরে থাবড়াতে লাগল।
নিবারণ স্কুল থেকে ফেরে। মন খারাপ করে খায়। সাইকেলটা নিয়ে হোগলা বনের পাশে একটা দীঘির ধারে বসে থাকে। সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফেরে। রোজ একটা শাঁকচুন্নি কেরিয়ারে বসে তার সঙ্গে কিছুটা রাস্তা আসে। কোনোদিন কথা বলে না।
আজ নিবারণ ফিরছে দীঘি থেকে হঠাৎ মাঝরাস্তায় তুমুল ঝড় শুরু হল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। শাঁকচুন্নি তো হাওয়ার তোড়ে ফস্ করে কোথায় উড়ে গেল। এখন নিবারণ কি করে? বড় একটা বটগাছের তলায় সাইকেলটা ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। দেখতে দেখতে বৃষ্টি চলে এলো। কি মোটা মোটা ফোঁটা রে বাবা! নিবারণ গাছে উঠতে জানে। একটু উঁচুতে উঠে একটা বিড়ি ধরিয়ে বসল।
বেশ ঝড়জল হচ্ছে। নিবারণের মনটা উদাস হল। কে বিয়ে করবে তাকে? যে-ই শোনে তার বাড়ি ভূত আছে, সে-ই পিছিয়ে যায়। এদিকে নিবারণের বয়েস তো আর পিছিয়ে যায় না তা বলে, সে তো খালি এগোয় আর এগোয়…..
আহা দাদা কদ্দিন পর বিড়ির এই মিষ্টি গন্ধটা পেলাম গো…
গাছের উপর থেকে খ্যানখ্যানে গলায় কে যেন বলল। নিশ্চয়ই লিকদাদু। ব্যাটা এই গাছেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। সাইকেলের দোকান ছিল। বিড়ি খেয়ে খেয়ে গলায় ক্যান্সার ধরল। সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে দিল গলায় দড়ি। দারুণ লিক সারাতো বলে সবাই বলত লিকদাদু।
নিবারণ বিড়িটায় টান দিয়ে বলল, এখনও সাধ যায়নি তোমার দাদু….
লিকদাদু বলল, এ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা রে নিবারণ... তোদের জেনারেশান বুঝবে না... আমরা ভালোমন্দ ভেবে কি আর খাই রে... এ আমাদের ভালোবাসা…
তুমি গলায় দড়ি দিলে তো সেই যন্ত্রণার জন্যেই... তোমার ভালোবাসার জিনিসের দেওয়া রোগ... মানবে তো?
লিকদাদু বলল, সে না মানার কি আছে। তবে লোকে বলে আমি নাকি যন্ত্রণার জন্য মরেচি…. ন্যাকা, যেন আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জম্মেছি... বাপ ছিল জাত মাতাল। কি করে যে আমি আর মা রাতদিন পরিশ্রম করে নিজেদের পেটের ভাত আর বাবার মদের জোগান দিয়েছি সে আমরাই জানি। সে জন্য মরলুম না রে…. মরলুম ওর জন্য... আমি যত ভুগি ওর তত কষ্ট.. এক মনের... দুই অর্থের। আমি কি শেষে ওকে রাস্তায় নামিয়ে মরতাম নাকি? এতবড় স্বার্থপরতা আমার দ্বারা হত না।
নিবারণের বিড়ি শেষ।
লিকদাদু বলল, শোন না, মিত্তিরদের বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে কয়েকটা কচিপাতা ছিঁড়ে মানসীকে দিয়ে আয় না রে। বড্ড দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু আমার গন্ধে টের পায়। কষ্ট পায়। আমিও পাই।
নিবারণ বলল, আচ্ছা যাব।
নিবারণ চুপ করে বসে। লিকদাদুও। মাঝে মাঝেই জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। চারদিক ঝাপসা লাগছে এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।
আচ্ছা দাদু, আমায় একটা কথা বলো, এই যে আমি আমাদের ওঝার কাজটা শিখলাম না… এটা কি ঠিক?
লিকদাদু বলল, সে ঠিকবেঠিক বিচার করার আমি কে বল? তোর মনে কি সংশয় আছে?
নিবারণ বলল, তা নেই, তবে ঠাকুমা কষ্ট পায় দেখে আমিও পাই…
আসলে তোর ঠাকুমা একটু সেকেলে… তুই মন খারাপ করিস না... বেশ করে পড়া, গ্রামের ছেলেমেয়েগুলোকে শিক্ষিত কর… আর এবার একটা বিয়ে কর…
নিবারণ বলল, ধুর... কেউ আমাদের বাড়ির নাম শুনলেই আর সাহস করে না…
তা যা বলেছিস… আজকালের ছেলেমেয়েগুলোর শৌখিন প্রাণ…. সেদিন কি মনে হল একটু লোকাল ট্রেনে চেপে ফিরছি... শেষ ট্রেন…. দুটো ছেলে কানে কি একটা সরু তারের মত গুঁজে বসেছিল। আমার হাঁচি পেল। এত জোরে হাঁচিটা হল যে আমার গলা থেকে মাথাটা ট্রেনের ছাদে গোঁত্তা খেয়ে আবার ধড়ে বসে গেল। ও বাব্বা, সে বাবুরা এমন দাঁতকপাটি লেগে পড়ল যে আমার লজ্জাই লাগতে লাগল। তা একটা বিড়ি ধরা না আবার…. একটু গন্ধটা পাই…
নিবারণ বিড়ি ধরালো। হঠাৎ বাড়ির পেত্নীটা এসে বলল, দাদাবাবু, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলেন, আপনার জন্য ঘটক এসে বসে আছে….
হইচই ঘটকের মাথায় ক্লাস সিক্স থেকে উকুন। গবেষণাগারে পাঠালে কত জাতের উকুন যে পাওয়া যেত হইচই ঘটকের মাথায় সে বলা যায় না। পিঠ অবধি চুল, চলন বলন মহিলাদের মত, হইচই ঘটক এ গ্রামের একমাত্র ঘটক।
নিবারণ এসে দেখল হইচইদা’র উকুন বেছে বেছে পেত্নীটা খাচ্ছে আর ঠাকুমা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কি সব বলে যাচ্ছেন।
নিবারণ ঢুকতেই হইচই এক ধাক্কায় পেত্নীটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, এক্কেবারে রাজযোটক, বুঝলেন… কই এদিকে এসো... কি হল, কাছে এসো... আমায় আবার ভয় কিসের গো? আমি তো ঘরের মানুষ!
বলতে বলতে ছবি বেরোলো। মেয়ের নাম ধুতুরা। তন্ত্রমতে সাধন করেছে। বয়সে নিবারণের চাইতে মাস তিনেকের বড়। ওতে কিছু নেই। কিন্তু শর্ত একটাই, চাকরি ছেড়ে ফুলটাইমের তন্ত্রসাধনায় আসতে হবে। হানিমুন হবে কামাক্ষায়।
নিবারণ ভাবতে সময় নিল। সময় পেল তিনদিন। সব ঠিক থাকলে সামনের অমাবস্যাতেই বিয়ে।
নিবারণের মনের সব সুখ ফুরিয়ে যাওয়া তুবড়ির মত এক কোণায় পড়ে থাকে। কিছুতেই সুখ নেই। সারাদিন ভাবে কিভাবে এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কি মনে হল একদিন মাঝরাতে সেই লিকদাদুর গাছটার নীচে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু এত হৈহল্লা কিসের? কয়েকটা ডাল পেরিয়ে উপরে উঠে তো চক্ষু চড়কগাছ, এত এত ভূত কি করছে এখানে?
নিবারণকে দেখে সবাই হঠাৎ করে চুপ। লিকদাদু এগিয়ে এসে বলল, কিরে, এতো একদম ঝিমিয়ে পড়েচিস দেকচি... ওরে ওর বিয়ে... কিন্তু সে নিয়ে অনেক জটিল শর্ত….
লিকদাদু সবটা বলল সবাইকে। আবার একটা হইচই পড়ে গেল। সবাই বলতে চায়। কিন্তু কি বলতে চায়?
কিছুক্ষণ গুনগুন চলার পর লিকদাদু বলল, বেশ, তোর একটা উপায় আমরা ভেবেছি। আমরা তোকে ক’দিনের জন্য হাপিশ করে দেব। তুই এখানেই থাকবি, কিন্তু কেউ দেখতে পাবে না। রাজী?
না, রাজী নয়। এইভাবে পালিয়ে সে কেন যাবে সমস্যা থেকে? তাছাড়া পড়িমরি ঠাকুমাকেই বা কে দেখাশোনা করবে? না, এই প্ল্যান বাতিল!
আবার সবাই গুনগুন করতে শুরু করল। হঠাৎ বাড়ির পেত্নীটা এসে হাজির। সে বলল, আমি সব সমাধান করে দিতে পারি।
পেত্নীকে কেউ পাত্তা দিল না। নিবারণ দেখল কিছুটা দূরে তার সঙ্গে যে ফেরে সেই শাঁকচুন্নিটা দাঁড়িয়ে আছে। যেন তারই অপেক্ষায়।
নিবারণ সবাইকে এড়িয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
সে বলল, একবার হোগলা বনের দিকটায় আসুন।
দু’জনে হোগলা বনের ধারে এসে বসল। নিবারণ বলল, আপনি সব শুনেছেন নিশ্চয়ই।
সে বলল, হ্যাঁ। আপনি স্কুলে পড়াচ্ছেন সে ভালো। আমাদের অনেক অনেক বাচ্চা আছে যাদের বাবা-মা সব এই করোনায় এদিকে চলে এসেছে। আর শুনেছেন তো কত কত বাচ্চাও আত্মহত্যা করে এদিকে চলে এসেছে। আমি ওদের জড়ো করে সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি যদি ওদের ভার নেন। সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন হলেই হবে। অনেকেই তো অনলাইনে পড়ার জন্য মোবাইল কিনতে না পেরে….
নিবারণের চোখ ছলছল করে উঠল। দীঘির ওপারে সার দিয়ে বাচ্চারা সব দাঁড়িয়ে। ওদের পড়াতে হবে! এতো দারুণ প্রস্তাব।
আমাদের গল্প এখানেই শেষ। পড়িমরি ঠাকুমাও সব মেনে নিয়েছেন, বরং বলা যায় খুব খুশী হয়েছেন। তিনি প্রায়ই নাড়ু, লাড্ডু বানিয়ে বাড়ির ভূতগুলোর সঙ্গে এসে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ান। লিকদাদুও আসেন মাঝে মাঝে। তিনি ওদের ছড়ার গান গেয়ে শোনান। আর কারোর মনে এখন কোনো দুঃখ তো নেই-ই, বরং নিবারণের বাড়ির ভূতেদের এই পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ফিরে এসেছে।
(ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩১ জন করে বাচ্চা আত্মহত্যা করেছে NCRB-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে লকডাউনের প্রভাবে নানা কারণে।)
[ছবি - Suman]