সৌরভ ভট্টাচার্য
11 June 2020
পাখি কখন উড়ে যায়.... বদ হাওয়া লেগেছে গায়...
মেট্রোরেলের ভিড়ের মধ্যে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারীর গলা। ধীরে ধীরে গাইছেন। আমার হাতে ধরা মায়ের নানা পরীক্ষার রিপোর্ট। ভালো না রিপোর্ট। ডাক্তার বলেছেন, সময় বেঁধে দিয়েছেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের। ট্রেনে আচমকা দেখি প্রিয় শিল্পীকে। প্রণাম করলাম, ভিড় ঠেলে, পা ছুঁয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, কই যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। শুনে চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে গাইলেন - পাখি কখন উড়ে যায়... বদ হাওয়া লেগেছে গায়...
বদ হাওয়া। খাঁচার ভিতর অচিন পাখির যাতায়াতের ঠাহর কি আমরা করতে পারি? এ তো বাঁশের খাঁচা। ঘুণ লাগলে উপায় নেই। খেতে, পরতে, শুতে শান্তি নেই। প্রিয় মানুষের শরীরে ঘুণপোকা কাটার আওয়াজ। কান্না নয়। বিস্ময়। জীবন যেন আহ্নিকে বসেছে। বলেছে, আমায় আর ডেকো না। আমি ফিরব। আমি কাকুতিমিনতি করে বলছি, কিন্তু তুমি যে আমার! কোনো উত্তর নেই। ভরা সংসারে বৈরাগী কারা ঢুকে পড়েছে বন্যার জলের মত। চারদিকে চুপচাপ ফিসফাস। বলছে, কেউ তোমার নয়, তুমি নিজেও কারোর নয়। তোমার সময় এলে তুমিও এমনভাবে বসবে আহ্নিকে। কেউ কেউ বসে অসময়ে। বড় অসময়ে। তোমার ক্ষুদ্র স্মৃতি। তুমি জানো না তাই, এই নিয়ম। যেমন আসা, তেমনই ছেড়ে যাওয়া। তোমার কোনোটাতেই নেই অধিকার। তোমার নেই জগতস্মৃতি, জীবনস্মৃতি। যার স্মৃতি নেই সে অজ্ঞান। তুমি নির্বোধ। অল্প আলোয় চোখ ধাঁধিয়েছে আসল আলো ভুলে।
প্রদীপের শিখাকে আগলাতে হবে - এ প্রতিজ্ঞা। এ জেদ। তবু বাতাস জানলা দিয়ে আসে। দরজা দিয়ে আসে। ঘুলঘুলি দিয়ে আসে। প্রাণের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে সুর ছড়িয়ে পড়ে - যেতে নাহি দিব।
তবু, এ সংসারে ঢেউ ওঠে, পড়ে। হেরে গিয়ে জিতে যাই। যে যায় সে যায়। ভালোবাসা যায় না। কথারা যায় না। খাঁচাটুকুই যায়। সে অচিন পাখি অল্প অল্প চেনা হয়। তার ডানায় আমার সংসারের সুর নেই। আমার সংসারে তার ছায়া আছে কেবল। গ্রীষ্মের দুপুরে চিলের ডাকের মত তার ডাক কানে আসে। মনের ভিতর বৈরাগী বলে, যাবে না? চলো, তোমার থালাবাসন, বাগান, ছাদ-ঘর-জানলা তোমায় অন্ধ করে রেখেছে। অন্ধতার সুখ ছাড়বে না? চলো চলো। বুকের মধ্যে কান্নার দোলা। যে কান্না সুখ। যে কান্না জড়তা ছাড়িয়ে জেগে ওঠার কান্না। অচিন পাখি অল্প অল্প চেনা যেন। তার ডানার শব্দে সেই গান ফিরে ফিরে আসছে, "দিনান্তবেলায় শেষের ফসল নিলেম তরী' পরে.... শুনি শুধু মাঝির গান, আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে".....
সব হারিয়ে গেলে যা বাকি থাকে সে আর হারায় না। তাকে হারানো যায় না। তার কাছে চিরকালের ধরা। আলগা হাতের বাঁধনের মোহে, সে চিরকালের হাতের বাঁধন বোধ হয়নি। তার কোনো পরিচয় নেই। সে ডাকে না। আমার ডাকের অপেক্ষায় থাকে। সমস্ত পরিচয়ের জগত পার হয়ে সীমানায় এসে একা দাঁড়ালে সে পাখির ডানার শব্দ কানে আসে। গায়ে শ্মশানের চিতার আগুনের তাপ লাগে। নিজের দেহের পুড়ে যাওয়ার গন্ধ আসে নাকে। পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ হতে হতে শুনতে পাওয়া - সময়হীন, পরিচয়হীন, সুখ-দুঃখহীন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিষাদ-আনন্দহীন এক গভীর শান্তি ঘিরে ধরছে। চারদিক আলোয় আলোকময়। আমার খোঁজ কারোর নেই। কারোর খোঁজের তাড়া নেই আমারও। কোথাও কিছু হারায়নি। সময় মানে মিথ্যা। যা আছে তা আছে চিরকাল। যে নেই তা আদতে কোনোকালেই যেন নেই।