Skip to main content

রমাকান্তর আজকের বক্তৃতার বিষয়, "মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ"।

 

কিন্তু গাড়িতে যেতে যেতে মনটা ভীষণ খচখচ করছে রমাকান্তর। কেন জানি মনে হচ্ছে বাইরের দরজার তালাটা একবার টেনে দেখলে হত। তালাটার একটু গোলমাল আছে। চাবি ঘুরে যায়, কিন্তু তালাটা গলা ঝুলিয়ে কাত হয়ে খুলে যায়। এতক্ষণে কি খুলে গেছে তবে? কেউ ঢুকেছে? যে ঢুকেছে সে চোর না মানুষ?

রমাকান্ত দর্শনের অধ্যাপক। রমাকান্তের গুরুর কথা এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক। কারণ রমাকান্তের বর্তমান জীবনে তাঁর বেশ প্রভাব। তো সে গুরুর ভক্তেরা বলে তিনি ছিলেন নাকি উচ্চকোটির সাধক, ফুল্লরাবাবা। তিনি কেউ গেলেই বলতেন, বাবা কাম ত্যাগ করো, বাবা কাম ত্যাগ করো। একজন মনোবিদ বলেছিলেন ফুল্লরাবাবার কাম নিয়ে এত অবসেসান কেন? যে যাতে যত বেশি অবসেসড, মানে যে অস্বাস্থ্যকর চিন্তাটা সে থামাতে চায়, কিন্তু পারে না, সেইটাই তো সে বারেবারে বলে। যাকে আমরা গোদা বাংলায় বলি বাতিক। মানে মনের মধ্যে লুপ।

তো সেই মনোবিদ ছিল আবার রমাকান্তের বন্ধু। সে বলল, তোর গুরুর হেব্বি কাম চিন্তা, নইলে রাতদিন সবাইকে এক উপদেশ দেয় কেন? স্বাভাবিক একজন মানুষ তো কখনওই এত 'কাম কাম' করে বেড়ায় না রে। যদিও পুরো দেশটাই হাজার একটা বাতিকে মেতে। নানা বাতিকে এমন সব বিকার বাধিয়ে তুলেছে যে সেগুলো ছাড়া বাঁচাকেও এখন তার অস্বাভাবিক লাগে। একটা বাতিক ছাড়ে তো আরেকটা বাতিকে চাপে। নিজেই নিজের জন্য বাতিক খোঁজে। কিছুতে একটা না দস্তুর মত ক্ষেপে, শেষে নিস্তেজ হয়ে না পড়লে সেটাকে সিদ্ধাবস্থা বলে চালাবেই বা কি করে? যত্তসব আকম্মের ঢেঁকি!

রমাকান্ত চটে যায়। কিছু বলতে পারে না। যুক্তিগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। একদিন গিয়ে গুরুকে একান্তে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, আপনি এত রাতদিন কাম ত্যাগ, কাম ত্যাগ করে উপদেশ দেন কেন?

গুরু চোখ বড় করে বলল, বাবা, তুমি দেড় বছর দীক্ষা নিয়ে একি কথা বললে গো! রাম বাদ দিলে কি জগতজোড়া শুধু কাম দেখো না? আমি তো রাতদিন তাই দেখি। হয় রাম, নয় কাম। রাতদিন অশুদ্ধ আত্মা, পাপাত্মা, কামকীট আমায় জ্বালিয়ে মারে। একটু ফাঁক পেলেই ন্যাংটো মেয়েমানুষে মনের আনাচে কানাচে ভরে যায়। আমি হাত-পা ছুড়ে কাঁদি। তারপর যে না আমার ইষ্ট এসে তীর কি খাঁড়া দিয়ে সব কেটে দিয়ে যায়। এই তো সবার মনের অবস্থা। তোমারও কি তাই নয়?

রমাকান্ত পড়ল বিপাকে। না তো, দীক্ষা নেওয়ার আগে তো তার এত শুচিবাই ছিল না, এত চারদিকে অশোভন, অশ্লীল ভাব আসত না! তবে? তবে একি হচ্ছে তার? যা তাড়াতে রাতদিন এত মনের ঘানি টানছে, উলটে সে-ই কি তার জাল বিছিয়ে তাকে ধরছে!

রমাকান্তের ঘাম হতে শুরু করল। বগল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। রমাকান্ত খেয়াল করল তার নিজের বগলের কথা ভাবতেও অশুদ্ধবোধ জন্মালো। সেও কি তবে অবসেসানে ভুগছে? একি হচ্ছে তার? সত্যিই তো এখন তার মনে জোর করে ব্রহ্মচর্য পালন, মেয়েদের দিকে ওসব ভাবে না তাকানো, এই নিয়ে এত ভাবনা থাকে, এত শ্রম হয় যে শান্তিই পায় না একটুকুও। শেষে গুরুদত্ত নামের ঘোর তৈরি করে একটা আরাম পায়। কিন্তু সে-ও তো ক্ষণিকের। তবে? সেকি একট অবসেসান কাটাতে গিয়ে আরেকটা অবসেসান তৈরি করে নেয় নিজের মধ্যে? এতো ভীষণ ভয়ংকর খেলা! জীবনের কত দিক তার কাছে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। এতো ভালো নয়! এ তো নিজেকে নিজের তৈরি কারাগারে আটকে রাখা! যাকে সে আনন্দ বলছে, সেকি সত্যিই আনন্দ? সে তো নিজের মধ্যে নিজের এক ঘোর তৈরি করে ডুবে থাকা। এ তো নেশা। এতে তো কোনো স্বাস্থ্যকর সুখ নেই! বরঞ্চ ইদানীং নিজেকে কেমন অন্যদের থেকে বেশি পবিত্র, স্পেশাল মনে হচ্ছে। মনটা সঙ্কীর্ণ হচ্ছে।

রমাকান্ত তার মনোবিদ বন্ধু সুধীরের সঙ্গে ক'টা সিটিং নিয়েছিল। ঠিক সিটিং না, আলোচনা বলা চলে। সুধীর বলেছিল, দেখ রমা, তোর এই অবসেসিসভনেস তোর মধ্যে নানা অযৌক্তিক, বাতিক টাইপের ভয়ও তৈরি করবে। যেমন তোর মনে হবে আজ ট্রেনটা যদি টাইমে আসে তবে আমার লেকচারটা ভালো হবে, যদি আজ আমি বাসে উঠেই ডান দিকে সিট পাই তবে আমার এ বছর আর সুগার বাড়বে না... এই সব কুসংস্কারগুলো তোকে ঘিরে ধরবে। কারণ অবসেসান থেকে ভয় তৈরি হয়, আর ভয় থেকে তৈরি হয় রাজ্যের কুসংস্কার। কুসংস্কার কিছু সমাজ দেয়। আর কিছু মানুষ নিজে নিজে তৈরি করে গোপনে। টক্সিক হয়ে যায় ভিতরটা নিজেকে নিয়ে।

রমাকান্ত থ বসেছিল। তার এই ধরণের কুসংস্কার তৈরি হয়েছে তো। দিন যত যাচ্ছে তত বাড়ছে, টের পাচ্ছিল তো। কিন্তু লিঙ্ক করতে পারছিল না কিসের থেকে হচ্ছে এগুলো। এখন পারছে। ভয় করছে। কিন্তু এ ভয় যৌক্তিক ভয়, তাই এই ভয়ের সঙ্গে কোনো লজ্জা তৈরি হচ্ছে না। স্বাভাবিক লাগছে।

রমাকান্ত জিজ্ঞাসা করল, এগুলো হয় কেন রে? আমরা কেন একটা অবসেসানকে প্রশ্রয় দিই?

সুধীর বলল, আমার মনে হয় দুটো কারণ। এক আমরা রিয়েলিটিটাকে বাইপাস করে সাফারিংটা কমাতে চাই কিছুটা। আর দুই, আমরা সবাই তো আলটিমেটলি পাওয়ার চাই কিছুটা। আমাদের টাকা-পয়সা, মান, স্টেটাস, জ্ঞানার্জন ইত্যাদির একটা স্থূল কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো পাওয়ার। আমরা ডমিনেট করতে চাই। এই অবসেসানটা তো থেকেই যায়, তাই না? সেটা যখন সোজা রাস্তায় না আসে তখন আমরা এই সব ক্রিড বা অকাল্ট প্র‍্যাক্টিসে মেতে যাই। এই আরকি!

রমাকান্ত জিজ্ঞাসা করেছিল, তবে অধ্যাত্ম জগতে সবটাই কি এরকম গোঁজামিল?

সুধীর বলেছিল, না, তা নিশ্চয়ই নয়, উন্নত চিন্তা, উদার অনুভবের মানুষ নিশ্চয়ই আছে, তবে বেশিরভাগটাই এরকম। হয়, বেজায় ইগোয়েস্টিক, মানে, হোলিয়ার দ্যান দাও, নইলে এরকম বাতিকগ্রস্ত, আর নয় তো ভীষণ সঙ্কীর্ণ, নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন।

রমাকান্ত এরপর গুরু ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু কিছুটা বাতিক থেকেই যায়। সুধীর বলে এটা ওই অভ্যাসগুলোর রেসিডুয়াল পার্ট।

আবার শুরুর গল্পে ফিরে আসি। তো রমাকান্ত এখন গভীর উদ্বিগ্নতায়, তালাটা কি টেনে এসেছে? মানুষ মানে কি চোর? মানুষের উপর বিশ্বাস কি হারাচ্ছে তবে? কিন্তু অবাস্তব হয়ে থাকাই কি বুদ্ধিমানের কাজ? গাড়ি ঘোরাতে বলবে? না, বরং পাশের বাড়ির বৌদিকে ফোন করে দেখে নিতে বলি….

ফোন রিং হতে ওপাশ থেকে গলা, তোমার দরজায় আমি তালা দিয়ে দিয়েছি ভাই, তুমি তো যা বেখেয়ালি… তালাটা তো লাগাওনি... ভাগ্যিস আমার চোখে পড়ল... আমি কাপড় মেলতে গিয়েছিলাম ওদিকে ভাগ্যিস... তোমার দাদার তো আজ আবার নাইটডিউটি... বলল আজ আলুপোস্ত আর ডিমের তরকারি রাঁধতে... এদিকে ডিম তো নেই…

রমাকান্ত ফোন ধরে হুঁ হুঁ বলে যেতে লাগল। বৌদি এখন ফোন ছাড়বে না। অন্তত পনেরো মিনিট। চারবার রাখছি বললে, তবে রাখবে। এও কি অবসেসান?

রমাকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখটা বুজে গাড়ির সিটে পিঠটা এলিয়ে দিল। ঘুম পাচ্ছে।