Skip to main content


       (সেই সব তথাকথিত প্রান্তিক মানুষদের জন্য, যাদের কথা শুনলে মনে হয়েছে কত সমান্তরাল জগতের পাশাপাশি হেঁটে চলেছি)


        মাথায় একটা টুপি, গায়ে চেক চেক জামা, কালো প্যান্ট। হাতে লাঠি। চুলে পাক ধরেনি এখনও তেমন। স্থূলকায় ঈষৎ। সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। তিন তলায় ফ্ল্যাট। দরজা খুলতেই সূক্ষ্ম মশারির জালের মত নিঃসঙ্গতা লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটা প্রস্তুত ছিল। লাঠিটা দরজার ডানদিকে রেখে বাথরুমের দিকে এগোলো। বাইরেটা কালো করে আছে শ্রাবণের মেঘে।
        শাওয়ারের আওয়াজ সারা ঘরে সিম্ফোনির মত বাজছে। দক্ষিণ দিকের খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। মেঝের উপর খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম, বিন্দু বিন্দু জল ঘামের মত জমতে লাগল। মাঝখানে একটা হলঘর। তার ডানদিকে একটা মাঝারি মাপের কাঁচের টেবিল। তার উপরে রাখা আজকের কাগজ, তার উপরের দিকটা হাওয়ায় উড়ছে। ঘরের মধ্যে একটা অলসতা, পরিপাটি মনোযোগ নিয়ে কিসের যেন অপেক্ষায়। 
        একটা কমলা রঙের টাওয়েল জড়িয়ে বাইরে বেরোলেন। ফর্সা ধবধবে গা। পিঠের উপর ডান দিকে একটা লাল তিল। বয়সের ছাপ চামড়ায় নেই। টানটান চামড়া। ফ্রিজ থেকে চিকেন, ভাত, ডাল বার করে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। মাইক্রোওয়েভে গরম করে খাবার টেবিলে এনে রেখে, জানলাটা আটকে, এসিটা চালালেন। টিভিটা অন্ করে খাবার টেবিলে বসলেন।টিভিতে বলিউডের সিনেমার গল্প হচ্ছে ইংরাজিতে। 
        বৃষ্টির আওয়াজের সাথে সাথে বাজ পড়ার আওয়াজ হতে লাগল। চিন্তিত মুখে একবার বাইরে তাকালেন। ঘাড় গড়িয়ে এখনও জল পিঠ বেয়ে গড়াচ্ছে। এটাই বরাবরের স্বভাব, মাথা মোছেন না স্নানের পর। বসে বসেই মিউজিক সিস্টেমটা অন্ করলেন। জগজিৎ সিং ঘরের নীরবতা ভেদ করে জেগে উঠলেন। টিভির ভল্যিউম কমিয়ে ধীরে ধীরে ভাত চিবোতে লাগলেন, অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন আজ সকাল থেকে।
        যৌনতাহীন জীবন কোনোদিন ছিল না। আজও নেই। কিন্তু যৌনতার কোনো সঠিক ঘরে তিনি পড়েন না। চলতি বাংলায় হিজড়া। ফ্ল্যাটে অনেকে তাই বলে, হিজড়া সাংবাদিক। একটা কভারেজ ওনাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয় – ‘যে জন আছে মাঝখানে’। কয়েক মাস নিজে যৌনকর্মী হয়ে কাজ করেছেন। কলকাতায় নির্দিষ্ট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কাস্টমার নিয়ে গেছে কোনো জনহীন ফ্ল্যাটে, ঘরে, মাঠে, বন্ধুর বাড়িতে, গ্রুপে, একা – নানা অভিজ্ঞতা। এটা ঠিক পেশাগত আকাঙ্ক্ষায় করেছেন তা নয়। জেদ, আক্রোশ, স্বাভিমান সব মিলিয়ে এমন একটা কিছু, যে সম্পাদক বলার সাথে সাথেই তিনি অনুভব করেছিলেন, তিনি যেন এই প্রস্তাবটায় 'হ্যাঁ' বলার জন্য ছোটোবেলা থেকে অগুনতিবার ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয়ে আসছেন। তাঁর অনেক কিছু বলার আছে। বহু পুরষ্কার পেয়েছেন লেখাটা বই হয়ে বেরোনোর পর।
        শোয়ার ঘরে গেলেন। সাদা ধবধবে চাদর। ডাবল বেড খাট। ঘরের উত্তরদিকে একটা বড় ঝুল বারান্দা। সেখানে যাওয়ার দরজাটা এখন। দেওয়ালে বিরাট একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট পেন্টিং। এসি অন্ করা। ঘরের টেম্পারেচার প্রায় পনেরো কি ষোলো হবে। মাথার কাছে তেপায়া কাঠের টেবিল, উপরে কাঁচ, তাতে মোবাইলের চার্জার, একটা ল্যাপটপ, একটা বাংলা ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশানের বই রাখা। ঘরের সাথে বাথরুম দক্ষিন দিকে। সারা বাড়ি মিউজিক সিস্টেমের স্পীকার। গুলাম আলি'র গজল চলছে। ইংরাজি খবরের কাগজটা নিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়তে শুরু করলেন। এই বিছানা বহু প্রেমহীন শারীরিক আবেগের সাক্ষী। প্রেমের মত অভিনয়ে দক্ষতা অর্জন করতে বহুকাল আয়নার সামনে দাঁড়াতে সাহস হত না। এখন সব অভ্যাস। ভালোবাসা বললেই ফোটে, চাইলেই ঝরে যায়। পায়ের নীচে সমাজ না থাকলে ভালবাসার অঙ্কুর আকাশ পেলেও জল পায় না, এটা মেনে নিতে শিখেছেন। তাই ভালোবাসায় আস্থা হারাননি। যৌনতায় নিরাপত্তা অর্জন করেছেন।
        চোখে ঘুম জড়াচ্ছে। চশমাটা টেবিলের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে টানটান হয়ে শুলেন। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। ঝুলবারান্দায় যাওয়ার দরজাটা ধাক্কা দিচ্ছে মত্ত হাওয়া। অনধিকার প্রবেশ চাইছে। ফোনটা মাথার কাছে। ফোনের ওদিকে হাজার হাজার অতৃপ্ত শরীরের সারি। টাকার জন্য সবাই নগ্ন হয় না। মানুষের মধ্যে একটা ঘুমন্ত লাভা আছে। সে জাগল শুধু সে-ই জাগে। বাকি অর্থহীন সব। সে জাগে, এমনকি এই না পুরুষ, না নারীর মাঝামাঝি শরীরেও জাগে। যে লক্ষণরেখা রক্তমাংসের শরীর বাইরের জগতে পেরোতে পারে না, তা পেরোবার ক্ষমতা এই অনলাইনের আছে। ফোন করলেই দরজায় ধাক্কা দেবে কোনো অপরিচিত, পরিচিত অবৈধ খিদে নিয়ে। দরজা বন্ধ হলেই যা বৈধ, অকৃত্রিমতায়।
        এলো একজন, ফোনের উত্তরে। তিরিশের শুরুর দিকে বয়েস। মাথায় পনিটেল, জিন্স আর টি-শার্টে ভেজা, ছিপছিপে কালো পাতলা একটা শরীর, যতটা না ডায়েটে তার থেকে বেশি অভাবে। কুন্ঠিত ছাতাটা জুতোর র‍্যাকের কাছে রেখে দাঁড়িয়ে। একটা শুকনো টাওয়েল আর শুকনো জামাকাপড় দিলেন। রাখাই থাকে। শরীর, মন দুর্যোগ বুঝে জাগে না, তাই সব তৈরিই থাকে।
        ফোন বাজল। অমিতের স্ত্রী'র ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। অমিত তাঁর অপরিণত বয়সের প্রেম, এখন ‘স্বাভাবিক বন্ধুত্বের’ ছদ্মবেশে, অমিত বোঝে, নিঃশব্দে এড়ায়। ছেলেটা নগ্ন হয়ে তার সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে। মাথার চুল খোলা, এক হাতে তার কয়েকটা ডান হাতের তর্জনীতে জড়িয়ে পাকাচ্ছে, মেয়েদের মত করে। “মেয়েদের মত” – এই শব্দবন্ধটার কোনো বিকল্প নেই। ঘেন্না লাগলেও এই শব্দতেই পূর্ণতার আস্বাদ, নাকি পূর্ণতার মতন একটা কিছু।
        তোমায় ড্রপ করে দেব, ওগুলো পরেই যাও... আমায় বেরোতে হবে এখন...

        রবীন্দ্রসদনের মোড়ে নেমে গেল ছেলেটা। ওই জামাপ্যান্ট পরে ‘মেয়েদের মত’ করে হেঁটে ভিড়ে মিলিয়ে গেল, কাজ না করেও যে টাকাটা পেয়েছে সেই টাকাটা কিছুটা পুষিয়ে দিতে চাইছে রাস্তায় ঠুমকা লাগিয়ে হেঁটে – নিজেকে প্রমাণ করে, নিজেকে তাচ্ছিল্য করে, নিজেকে উজাড় করে। ও ফিরবে না আর। এরকম অনেক জামা কাপড় ফেরেনি। ট্র্যাফিকে আটকে। বেশ জ্যাম। কাঁচ বেয়ে নামছে বর্ষা কলকাতা ভাসিয়ে। গাড়ির ভিতর ধীর শব্দে চলছে জগজিৎ সিং। সামাজিক জীবন আর অসামাজিক ভালোবাসা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে মাথা বুক শরীর ভাসিয়ে। কান্না পাচ্ছে। এরকম পায়। কিন্তু কাঁদতে নেই। তার হয়ে কাঁদে জগজিৎ।