Skip to main content

 ঝড়ে আটকে গেলাম চায়ের দোকানে। টিনের চালে শিল পড়ছে। বারবার মোমবাতি নিভে যাচ্ছে। ঝড়ের দাপট সামলাতে টিনের দেওয়াল থরথর করে কাঁপছে। আর কাঁপছে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া।

মহিলা একা। দেওয়ালে হরিচাঁদ ঠাকুরের ছবি। পাশে ছোটো খাট। টিনের চালা চুঁইয়ে জল পড়ছে। খাটের উপর রাখা দুটো বাটি। টুপ টুপ অনবরত আওয়াজ।

লিকার চা। সঙ্গে বিস্কুট।

একা থাকেন?

হ্যাঁ

বৃষ্টিতে বিছানা ভিজল যে...

ও কিছু না....

টিনের চালায় ফুটো যে

ও কিছু না...

হাসেন আর খালি বলেন, ও কিছু না। তবে কি কিছু?

আমার মেয়ে যে বাড়ি কাজ করে। সে বাড়ির মেসো, মাসি দুজনেই ডাক্তার। তাদের মেয়ের বিয়ে হল, জামাই মারা গেল। করোনায়। কত বয়েস হবে? আমার মেয়েটার চাইতে কদিনের বড়….

এই হল কিছু। মোমবাতির আলোয় চোখের কোল চিকচিক।

বলেন, আমার অভাব আছে। ওদের তো নাই। কিন্তু দুঃখ বিপদের আবার গরীব বড়লোক। মানুষের ব্যবহারটাই আসল দাদা। ওটাই থাকে….চা ঠিক আছে?

আছে।

আমার মেয়ের বিয়েতে গয়না পাঠালো। চাদর পাঠালো। শাড়ি দিল। দামী। ওরা আসলো না। ওদের অশৌচ। নইলে ঠিক আসত।

এগুলো কি দিদি?

জুতো। ছেলের লকডাউনে কাজ গেল। সে জুতোর ব্যবসা করল। হয়? শুধু পুঁজি আটকালো। এখন ড্রাইভারি করে।

এত জুতো…

ও কিছু না… হয়ে যাবে কিছু একটা।

বাইরে বিদ্যুৎ। ভিতরে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই। ভিজছে খাট। শিলের আওয়াজ। কিন্তু সুখ বসে আছে মোমবাতির আলোয় চওড়া হেসে। যে চওড়া হাসিকে ভয় পায় যম। যম মানে মৃত্যুর পরোয়ানা না। বিষাদের চোরাবালি।

বিষাদ? সময় কোথায়? আসবে কোদ্দিয়ে? দরজা কই?

উনি বললেন না, দেওয়ালে ঝোলানো হরিচাঁদ ঠাকুরের ছবি বলল।

ওদের বাড়ি যেদিন বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গেলাম, তখন তো লকডাউন। আমাদের তাও ঘরে বসালো। মিষ্টি দিল। কথা বলল। তখন তো বাড়িতেই ঢুকতে দেয় না লোকজন। আমার পাশের বাড়ির একজন জ্বর সর্দিতে মরল হাস্পাতালে বিছানা থেকে পড়ে। কেউ ছুঁতেই চায় না। সবার প্রাণে ভয়। হবে না? দিদিরা ওরকম না। ওরা তো ডাক্তার, ভয় তো ওদের কত, বলেন? আসলে দাদা ব্যবহারটাই আসল। আমি বললাম, মা, যা হয়েছে হয়েছে… তুই কাউরে একটা নিজে থেকে খুঁজে নিস… এতবড় জীবন একা… হয় না….

একজন টিনের নীচে ঝড় সামলাতে সামলাতে ভাবছে, যে সমাজের তলানিতে থাকে সে ভাবছে। মানুষের হৃদয় তো। বয়ে যায়। বাতাসের মত। তাতে সুগন্ধ, দুর্গন্ধ দুই-ই থাকে। তবু বাতাস নির্লিপ্ত। ঝড় হলেই বিপদ। ঝড়েই বাজে বাঁশি। বাঁশি মানে হৃদয়। যে বোঝে সে বোঝে। যার হৃদয় আছে সে একা হয় না তাই।

বৃষ্টি কমল। বেরোতে হবে।

বৃষ্টি হলে দাঁড়িয়ে যাবেন দাদা… নইলে শরীর খারাপ হবে…, আসবেন আবার…

আসব তো…

সারা রাস্তা গাছের পাতা, ফুল, ডাল ছড়িয়ে। বিদ্যুতের রেখা আকাশ চিরে এদিক ওদিক ফালাফালা করছে আকাশ। রাস্তার দুদিকে বড় বড় বাড়ি। সুখের আয়োজন। নিরাপত্তার আয়োজন। কই সুখ? কই নিরাপত্তা?

ও কিছু না…. বলার মত ধন নেই প্রাণে… সব সময় মন বলছে… আমি ভালো নেই…. বড় গরীব আমি…. যা কিছু আছে সে সব আছে ভবিষ্যতের বুকে, আর আছে ওর কাছে.. ও প্রতিবেশী.. সারাদিন সুখের লাইনে দাঁড়িয়ে… সুখ ফলাবো জমি নেই… ধার করা সুখে স্বস্তি নেই…. সুখ নেই… স্বস্তি নেই…

মোমবাতির আলোয় আলোছায়ায় ঘেরা প্রসন্ন মুখ… অভাব অভিযোগ আছে… তবে ও কিছু না….