Skip to main content

গোবিন্দের এই নিয়ে তিনটে রাত ঘুম হল না। ক্ষেতে যায়। গরুকে জাব দেয়। সন্ধ্যেবেলা তাস খেলতে বসে চণ্ডীমণ্ডপে। সব ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা। বাঁ হাতের কব্জীর উপর এমন একটা ফুলো উঠছে। টিউমার। এই মাস গেলে বিয়ে। শাঁখা গলবে? কি যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। 

     গোবিন্দের বউ নিরুদ্দেশ হয়েছে বছর এগারো হল। মাথায় গোলমাল ছিল। লোকে বলে ননদ বাণ মেরেছে। ননদের অনেক ঝাড়ফুঁক জানা আছে। বাড়িতে বিরাট কালীমন্দির। অর্শের মাদুলি দেয়। কত মানুষ যে অর্শের হাত থেকে বেঁচে গেল ওই মাদুলি পেয়ে সে মা'ই জানেন। কিন্তু ও কেন শেফালিকে বাণ মারবে? 

     লোকে কারণ বলে। কেউ বলে, শেফালির কুষ্ঠিতে নাকি লেখা ছিল সে গোবিন্দকে বিষ খাইয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে পালাবে। কেউ বলে, শেফালিও নাকি তুকতাক জানত। ও-ই নাকি আগে তার ননদকে বাণ মারতে চেয়েছিল। কাজ হয়নি। 

     গোবিন্দ সব শোনে। বিশ্বাস করে না। আবার করেও। গোবিন্দ দেখেছে কৃষ্ণপক্ষে তার যা না বিশ্বাস হয়, শুক্লপক্ষে তা-ই বিশ্বাস হয়। কি করে হয় গোবিন্দ বুঝতে পারে না। কিন্তু মাম্পিকে নিয়ে কি করবে? দিদি, অচলাকে বলতে সাহস পায় না। পাছে হিতে বিপরীত করে বসে। এদিকে দুশ্চিন্তায় নিজের ঘুম-খাওয়া মাথায় উঠছে। শাঁখা না পরতে পারলে মেনে নেবে শ্বশুরবাড়ি? 

     গোবিন্দ ক্ষেত থেকে ফিরছে, রাস্তায় বাল্যবন্ধু পরিতোষের সঙ্গে দেখা। কাঁচরাপাড়ায় রেলে কাজ করে। গ্রামে ছ'মাসে কি ন'মাসে এক-আধবার আসে। ওদের অনেক জমি-জায়গা এদিকে। থাকে না। 

     গোবিন্দের মন বলল, পরিতোষই এর বিধান দিতে পারবে। না হয় কাঁচরাপাড়ায় গেলেই হবে। বর্ধমান থেকে কাঁচরাপাড়া কদ্দূর? অবশ্য তাদের গ্রামই তো বর্ধমান থেকে প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা। গোবিন্দ বাইকে যাতায়াত করে। 

     পরিতোষকে নিয়ে শিব মন্দিরের চাতালে বসল। এ কথা সে কথা বলল। কিন্তু আসল কথাটা বলতে পারল না। কথা কানে হাটে। কে জানে যদি ছেলের বাড়ির কানে যায়? বৈঁচি কি কাঁচরাপাড়ার কাছে? কে জানে বাপু! 

     পরিতোষ উঠে গেল। গোবিন্দ শিব মন্দিরে বসে থাকল। বড় একটা নিমগাছ পাশে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। চোখটা জুড়িয়ে আসছে। খিদে পাচ্ছে যদিও। এগারোটা তো হবে। 
ভাই….

     অচলা দাঁড়িয়ে। লাল শাড়ি। কপালে বিরাট সিঁদুরের টিপ। কালো ছোটো মতন মানুষটা। চোখে চশমা। সারা মাথা সিঁদুর লেপা। 

     গোবিন্দের বুকটা ধক্ করে উঠল। বলল, দিদি তুমি এখানে….

     জুঁই এসেছিল। দিদি মাম্পিকে জুঁই বলে ডাকে। 

     জুঁই ওর হাতটা দেখালো। দেখ ভাই সামনেই ওর বিয়ে, ও হাতে শাঁখা গলবে না, আমি দেখলাম। এই নিয়ে হুজ্জুতি হওয়ার আগে তুই ওকে হাস্পাতালে নিয়ে যা আজই। 
গোবিন্দ আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু দিদি সেখানে অনেক লোক… যদি জানাজানি হয়ে যায়? 

     অচলা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। যেন কথা ক'টা বলেই চলে যাবে। এই কথাটা শুনে বসল গোবিন্দের পাশে। বলল, আরে বাবারও হাতে ওরকম হয়েছিল, মনে নেই? তারপর মাইতি ডাক্তারের পুরিয়া খেয়েই তো সেরেছিল। মনে নেই তোর? ভালো হোমিওপ্যাথি দেখাবি? 

     গোবিন্দ বলল, তোমার নিজের কিছু জানা নেই?

     হঠাৎ চোখমুখের ভাব বদলে গেল অচলার। রাগবে না কাঁদবে বোঝা যাচ্ছে না। গোবিন্দের মুখ শুকিয়ে গেল। দিদিকে সে ভয় করে। কেন করে জানে না। বউ নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে আরো ভয় পায়। দিদি একাই থাকে। জমিদার পরিবারের গিন্নীর অর্শ সারিয়ে দেওয়ার পর তারাই জমি দিয়ে, মন্দির বানিয়ে দিয়েছে। ওরা ঠিক এখন জমিদার নয়, তবু গাঙ্গুলি বাড়িকে সবাই জমিদারবাড়িই তো বলে।

     অচলা বলল, বউকে আমি পাগল করিনি ভাই। সে নিজেই হয়েছে। গ্রামশুদ্ধ লোকে যখন বলে, আমি চুপ করে থাকি। কেন জানিস? কারণ ওই মিথ্যের ভয়ে লোকে আমার কাছে ঘেঁষে না। লোকে জানে আমি যেমন অর্শ সারাতে পারি তেমন বাণ মারতেও পারি। 

     গোবিন্দ বড় বড় চোখ করে বলল, পারো না দিদি? 

     অচলার চোখ ফেটে জলের স্রোত নামলো। বলল, বাণ মারতে জানলে আমি নিজেকেই আগে মারতাম ভাই। তোর সুজনদাকে মনে আছে? বাবার কাছে আসত পান কিনতে?

     গোবিন্দের মনে আছে। তাদের পানের বরজ ছিল। এখন নেই। মায়ের মুখটা মনে পড়ল। লাল ঠোঁট। পানে। 

     ওই মানুষটাকে আমি চেয়েছিলাম। ওই আমাকে বলেছিল। আমি নিজে বলতে পারিনি। বাবা দেননি, আমাদের কুষ্ঠি মেলেনি বলে। কি হল বল, সে-ই তো মানুষটা রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে অকালে চলে গেল। 

     গোবিন্দ বলল, বাবা হয় তো জানতেন….

     বাজে বকিস না ভাই। আমি থাকলে মানুষটা যেত না ওভাবে…. তুই জানিস আমি বর্ধমান হাস্পাতালে একা গিয়েছিলাম ওকে শেষ দেখা দেখতে? জানিস না। কেউ জানে না। আমি সে রক্তমাখা মুখ আজও ভুলতে পারি না। ভুলতে চাইও না। তাই আমিও আর মানুষ থাকলাম না। কারোর কাছে হলাম দেবী, কারো কাছে ডাইনি। 

     অচলার চোখে এত জল? গোবিন্দের অবাক হয়ে দেখতে দেখতে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। দিদির হাতটা ধরল। যেন কত যুগ পর মাকে ছুঁলো। বলল, চল, জুঁইকে নিয়ে হাস্পাতালে যাই। যাবি? 

     অচলা তাকালো গোবিন্দের চোখের দিকে। তার নীচের ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। বলল, না ভাই, তুই যা। আমার কপালের সঙ্গে আর নিজেকে জড়াসনি। আমার ভাগ্যের রাস্তা আমিই ঠিক করে নিয়েছি। অমন সোনার মানুষটাই যখন রাস্তায় পড়ে মরে গেল, আমার জন্যে এই রাস্তাই সব। কোথাও থাকব মরে পড়ে…. তোরা ভালো থাক। ওর একটা ছোটো অপারেশানে সব ঠিক হয়ে যাবে। 

     অচলা উঠতে যাবে, গোবিন্দ অচলার হাতটা ধরে নিল। হাতে এত জোর আগে ছিল না তো! অবাক হল গোবিন্দ নিজের জোর দেখে। তার আটকাবার ক্ষমতা আছে?

     তুই বিয়েতে আসবি না দিদি? 

     অচলা হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করল না। ভাইয়ের হাতের উপর হাতটা রেখে বলল, মায়ের প্রসাদী ফুল পাঠিয়ে দেব। জুঁইয়ের মাথায় ঠেকিয়ে দিস। ওইতেই সব হবে। 
অচলা চলে যাচ্ছে। জুঁই চলে যাবে। মা, বাবা, বউ সব চলে গেছে। গোবিন্দ একবার মাথা ঘুরিয়ে শিবের দিকে তাকালো। হাত জোড় করে বলল, আমাকেও পাথর করে দাও ঠাকুর। তোমার মত। 

     গোবিন্দের চোখের থেকে কয়েক বিন্দু জল তার মাটিতে এসে পড়ল। গোবিন্দ মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলল, দিদিকে আর জুঁইকে দেখো ঠাকুর। 

     এই প্রথম তার মনে হল বউকে খুঁজতে যাওয়া তার দরকার। জুঁইয়ের বিয়ে হলেই সে বউকে খুঁজতে বেরোবে। না পেলে সে-ও না হয় নিরুদ্দেশ হবে! ক্ষতি কি?