Skip to main content

মন্দিরে এসে দেখে গোপাল নেই। ভোগ সামনে, প্রদীপের শিখা জ্বলে জ্বলে শেষের দিকে প্রায়। কিন্তু আসন ফাঁকা।

রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের গর্জন আরো প্রবল। বড্ড মানুষী। গোপালপুরের এই দিকে কেউ আসে না। এই মন্দিরটাও বহু পুরোনো।

কেউ কোত্থাও নেই। বালি শুধু বালি। চাঁদ ছোটো হচ্ছে, সামনে অমাবস্যা।

হঠাৎ কানে এলো নূপুরের শব্দ। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে।

ছুটে গেল। গোপাল পড়ে। গা খালি। কোনো গয়না নেই। চুরি হয়েছে সব। নূপুরটা পাশের একটা কচুগাছে আটকে, বাতাসের দুলছে, তার শব্দ হচ্ছে।

গোপালকে কোলে নিয়ে বসল সমুদ্রের ধারে। গায়ের আঁচলটা ঢেকে দিল গায়ে। নূপুরটা পরালো পায়ে। গোপালের একটা পায়ে।

=====

সে তো মন্দিরে রোজ আসে রাতে। ভোগের প্রসাদ নিয়ে যায়। সে আর বাবা খায়। কখনও কেউ এলে প্রসাদ পায়। অতিথি হয়ে এলে। চোর কি অতিথি হয়?

বাবার খাওয়া হবে না চুরির কথা শুনলে। বাবুরা রাগ করবে। তারা ভুবনেশ্বর থাকে। বছরে দু'বার আসে। হোলিতে আর জন্মাষ্টমীতে। যদি জানে তারা সব গয়না চুরি হয়েছে তবে তো জেলে দেবে তাকে আর তার বাবাকে। চাকরি ছাড়িয়ে দেবে।

সমুদ্র কি মানুষের কান্না বোঝে? তাও সমুদ্রের জল এতটা এগিয়ে এসে পায়ে লাগল লক্ষ্মীর। কান্না থামছে না তার। কি খাবে? বাবা তাকে নিয়ে এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবে?

======

বাবাকে সব বলল। বাবা সব শুনে চুপ করে থাকল। তারপর ভোরে উঠে বলল, মা সাবধানে থাকিস, আমি দু'দিন পরে আসব। বাবুদের সব জানিয়ে আসি।

======

বাবা দু'দিন পরে এলো। বলল, চল মা, আমাদের আর এখানে ভাত জুটবে না। কর্তারা আমার কাজে তুষ্ট নয়। চলে যাই চল।

কোথায় বাবা?

লক্ষ্মীর বয়েস তেরো। তবু মা-হারা মেয়েটা জানে বাবার চাইতে সে বড়। বাবা অনেক কিছু বোঝে না। সে বোঝে। যেমন তাদের যে এ গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে সে তো আগেই জানত। বাবা জানত না।

======

বাবা আর সে পুরী এলো। বাবা ভিক্ষা করবে। সেও মাঝে মাঝে ভিক্ষা করবে। রাঁধবে সে। সব সামলে নেবে। সে তো বাবার চাইতে বড়।

বছর গেল। বাবার শ্বাসকষ্ট ছিল। সেই রোগই বাড়ল। প্রচুর ভুগে একদিন মারা গেল। সে কাঁদল না। অত ভোগার চাইতে মরে যাওয়া অনেক শান্তির। কিন্তু সে কি করবে এখন? ভিক্ষা করল না। কাজ খুঁজল। মন্দিরের বাইরে অনেক বড় বড় দোকান। সেই কাজে লেগে গেল। দোকানে ফাইফরমাশ খাটে। এই করতে করতে পরিচয় হয় এর-তার সাথে। কিছু পরিচয় টেকে, কিছু ভেঙে যায়। সময় চলল নিজের মত। একদিন সে ডাক পেল কলকাতা থেকে।

পুরী ছেড়ে কলকাতায় এলো। কাজের জন্য। হোটেলে রান্না করার। বেলঘরিয়া স্টেশানের কাছে। রান্নার হাত তার ভালো। এ কাজটা জোগাড় করে দিয়েছে পুরীর এক পাণ্ডাই। এই হোটেলের মালিক ওদের ওখানেই ওঠে। পুজো দেয়।

লক্ষ্মী চাইছিল নতুন জায়গা। যেখানে তার কাউকে মনে পড়বে না। না বাবাকে, না গোপালকে। লক্ষ্মী মনের সবটুকু দিয়ে কাজে লেগে গেল। মন বসেও গেল। মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বর যায় মন খুব উতলা হলে। গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া চোখেমুখে মাখে। মায়ের কাছে এসে বসে, নাটমন্দিরে। বাবার কথা ভাবে। কান্না আসে। কাঁদে। বাড়ি ফিরে আসে।

=====

হোটেলের মালিকের ছেলের বিয়ে। ধুমধাম করে হবে। হোটেল বন্ধ থাকবে ক'দিন। লক্ষ্মীর অবশ্য ছুটি নেই। বিয়েবাড়ির রান্নার ভার তারই।

হোটেলের মালিকের বউ, সবিতা বৌদি লক্ষ্মীকে খুব ভালোবাসে। সবিতা ছেলের শ্বশুর বাড়ি যাবে, লক্ষ্মীও যাবে।

লক্ষ্মী গেল। বিশাল বাড়ি। কথাবার্তার পর মেয়ের ঠাকুমা বলল, আমাদের ঘরদালান দেখে যান!

এ ঘর, সে ঘর দেখতে দেখতে ঠাকুরঘরে এসে চমকে উঠল লক্ষ্মী। এতো তার গোপালপুরের গোপাল, সব গয়না গায়ে! তবে?

=====

মেয়ের ঠাকুমা বলল, মূর্তি তার ছেলের শ্বশুর তাকে দিয়েছে। গোপালপুরে নাকি এক মন্দির ছিল তাদের। একবার সব গয়না চুরি হল। প্রথমে ভেবেছিল হয় তো মন্দিরের পুরোহিত করেছে। তাকে কাজ থেকে তাড়ানো হয়েছিল। পরে জানা গেল তাদের এক আত্মীয় সব গয়না সমেত ধরা পড়েছে কটকে। অনেক খোঁজ করল সে পুরোহিতের। কাউকে পাওয়া গেল না।

এদিকে দিনে দিনে ব্যবসা পড়তে শুরু করল। দেনা বাড়তে শুরু করল। সে অবস্থায় কি আর মন্দির চালানো যায়? কিন্তু গোপালের সেবা কি করে হবে? তখন এ বাড়ির ছেলেকে, মানে তাদের জামাইকে দিয়ে দেওয়া হয় এ মূর্তি। আর শ্বশুর বলে গিয়েছিল, যদি দৈবাৎ কোনোভাবে পুরোহিত আর তার মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়, তবে যেন তাদের কুড়ি হাজার টাকা, আর একটা নূপুর দিয়ে দেওয়া হয়। যে নূপুরটা নিয়ে পুরোহিত দেখা করতে গিয়েছিল ভুবনেশ্বরে। আর শ্বশুরের হয়ে সে যেন ক্ষমাও চেয়ে নেয়।

লক্ষ্মীর চোখ উপচে জল। মেয়ের ঠাকুমা বলল, তোমার চোখে জল মা, তুমি কি তাদের কেউ হও?

লক্ষ্মী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না না ঠাকুমা, আমি তাদের গল্প শুনে কাঁদছি, কত কষ্ট মানুষকে পেতে হয়, ঈশ্বরের কি বিচার তিনিই জানেন, তাই না ঠাকুমা?

=====

গাড়িতে আসতে আসতে সবিতা বৌদি বলল, নিজেকে লুকালি কেন লক্ষ্মী?

লক্ষ্মী বলল, এত শাস্তি তো তারা পেয়েছেনই বলো... তাছাড়া বাবা আর আমি যে দোষী নই সেও গোপাল তাদের জানিয়েছে, নইলে চুরি তো কত হয়, ধরা আর কজন পড়ে বলো?... তাদের এত শাস্তির পর… আবার আমি কেন দিই বলো…. আমাকে দেখলেই সব পুরোনো কথা মনে পড়বে ওদের…. লজ্জা হবে, সঙ্কোচ হবে…. থাক তার চাইতে। গোপাল তো জানেন।

======

বিয়ে হল। ক'দিন পর মেয়ের ঠাকুমা এলো দেখা করতে। সবাই কথাবার্তা বলছে, লক্ষ্মী ঢুকল চা নিয়ে সবার জন্যে।

ঠাকুমা এগিয়ে এসে লক্ষ্মীকে বলল, মা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। এদিকে এসো…

উত্তরের ফাঁকা বারান্দায় দু’জনে দাঁড়ালো। এদিকে কাপড় মেলতে আসে লক্ষ্মী। আর বেশি কেউ আসে না।

ঠাকুমা বলল, তোমার জন্যেই আমার আসা আজ। আমি পর পর দু'দিন স্বপ্ন দেখলাম মা জগদম্বা বলছেন, ও নূপুর তোমায় দিয়ে দিতে। কেন জানি না, আমার মনে হয়, হয় সে তুমি…. নয় তুমি তাদের কাছের কেউ…. মানুষের কান্না আমি চিনি মা। দরদের কান্না আর ভুক্তভুগীর কান্না এক নয় মা, বুঝি আমি… তুমি না বললে আমি কিছু জানতে চাই না…. তবু যদি এই নূপুরটা রাখো…..

লক্ষ্মী কথা বাড়ল না। নূপুরটা নিল। ঠাকুমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ভালো থাকবেন মা।

পরে সবিতা বৌদিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি বলেছ ওদের কিছু?

সবিতা বৌদি বলেছে, না তো রে!

লক্ষ্মী চুপ করে থেকেছে। সত্যি কি সে গোপালই জানে।

=====

লক্ষ্মী দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বসে। মায়ের আরতি শেষ। বাড়ির সব ভেলোরে গেছে। দাদাবাবুর কিডনির অসুখ। হোটেল একবেলা খুলছে। তার কাজ নেই বললেই চলে।

হঠাৎ মনে হল বাবা এসে দাঁড়ালো সামনে। বাবা মায়ের মূর্তিতে প্রণাম করছে। ওই তো পৈতেতে ঝোলানো মন্দিরের চাবি। যার একটা চাবি থাকত তার কাছে। রাতে মন্দির বন্ধ করে তবেই আসত। লক্ষ্মীর চারদিকে কেমন একটা ঘোর তৈরি হল। বাবা তারদিকে তাকালো। কি যেন বলতে চাইল। লক্ষ্মী বুঝল না। হঠাৎ ঘোরটা ভাঙল।

লক্ষ্মী উঠে মন্দিরের দরজার কাছে এলো। কই, কেউ তো কোথাও নেই। একজনকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন এখন তিনি কোথায়?

পুরোহিত বলল, কেউ নেই তো.. আপনি ভুল দেখেছেন।

=====

লক্ষ্মী বাড়ি এলো। নূপুরটা বার করে হাতে নিল। এ নূপুরে তার অধিকার নেই। বাবা তাই বোঝাতে এসেছিলেন নিশ্চয়ই। তাই কথা বললেন না।    

নূপুরটা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালো। কোনদিকে যাবে? নূপুরটা কাকে ফেরাবে সে?

নূপুরটা হাতে নিয়েই বুঝল, তাকে যেতে হবে ভুবনেশ্বর। ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে তাদের। তার অনেক ক্ষোভ, রাগ, অভিমান জমে মনে। তাকে সমস্ত অন্তর থেকে ক্ষমা করতে হবে। এই তার তপস্যা। ক্ষমা করে দিতে হবে ওদের। নইলে সে শান্তি পাচ্ছে না, বাবা পাচ্ছে না, ওরাও পাচ্ছে না।

তারপর? আর কি ফিরবে? সব রাগ ক্ষমা করে দিলে?

একটা চিঠি লিখে পাশের বাড়ির হতে দিয়ে বেরিয়ে এলো লক্ষ্মী। আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না। সব অসহ্য লাগছে। আর ফিরবে না সে। এই নূপুরটা ফেরত দেওয়ার পর তার বুকটা শূন্য হয়ে যাবে। যত প্রতিশোধ স্পৃহা, যত অভিশাপ জমিয়েছিল ওদের জন্য সব হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সরু রাস্তা, যা অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে সবার অলক্ষ্যে, মিলিয়ে গেল। বুকটা হঠাৎ সমুদ্রের তীরের মত স্পষ্ট। সে যেন আবার সেই বালিকা। নিরাভরণ গোপালকে কোলে নিয়ে বসে। ক্ষমা করে দিলে গোপালকে পাবে আবার। হৃদয়ে। এতদিন শুধু আগুনই জ্বেলেছে, আরতি করেনি। আজ আরতির ঘন্টা বাজছে বুকে। তারা যদি কেউ বেঁচে না থাকে গোপালপুর যাবে, নূপুর সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলবে, আমি তোমাদের ক্ষমা করলাম, সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করলাম। এরপরের পথ গোপাল বলবেন। নিরাভরণ গোপাল।