সন সন করে বাতাস বইছে। বাতাসে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ। গন্ধ উত্তর দক্ষিণ ঘুরে পুব দিকে গেল। যেদিকে গঙ্গা। গঙ্গার পাড়ে বসে পিশাচ। পাগল। বাতাস থমকে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। পাগল বলল, এসেছিস। আয় বোস।
একটা লাশ ভেসে যাচ্ছিল। পাগল তুড়ি মারল বাঁ হাতে। ডান হাত নেই। কাটা। কী করে কাটল কেউ জানে না। পুলিশও না। পাগলও না। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে দেখল হাতটা নেই। যা নেই তা নিয়ে প্রশ্ন করে না পাগল।
লাশটা এসে ঠেকল পাড়ে। পাড়ে জঙ্গল। ঝোপ। পাগল তাকালো বাঁদিকে। শিস দিতেই ঝোপের ভিতর থেকে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠল। একটা কুকুর। দুটো কান নেই। কাটা।
সেটা দৌড়ে গিয়ে লাশের পায়ের দিকটা ধরল কামড়ে। টান দিল। দাঁতগুলো বসে গেছে লাশের হাড়ে।
পাগল বলল, এদিকে নিয়ে আয়।
=======
মড়াটা খোলা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে। যে আকাশের সঙ্গে মাটির কোনো সম্পর্ক ছিল না কোনোদিন। পাগল ঝুঁকে লাশের মুখের কাছে মুখ এনে বলল, শালা একা ছিল। মরেছেও একা। তারপর এনে কেউ ভাসিয়ে দিয়েছে জলে।
সজনে গাছে একটা প্যাঁচা বসেছিল। কানা সে। বাজির বারুদে পুড়েছে দুই চোখ। সে জিজ্ঞাসা করল, বুঝলে কী করে? পুড়ালো না কেন?
পাগল লাশটার পাশে শুয়ে, লাশটার ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বুকের উপর রেখে বলল, পুড়াবার খচ্চা দেবে কে রে শালা? আর বুঝলাম কী করে? সারা কপাল চিন্তার ভাঁজ। এতো চিন্তা একা মানুষ ছাড়া কে করে?
প্যাঁচা বলল, মানে বউবাচ্চা নেই বলছ?
পাগল তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, শালা তুই অন্ধ না? মেয়েমানুষ যে নয়, ব্যাটাছেলে বুঝলি কী করে?
কানা প্যাঁচা বলল, গন্ধে। কিন্তু তুমি বলতে চাও ওর বউবাচ্চা নেই?
পাগল বলল, কই বললাম? নিঃসঙ্গ তো বলিনি, বলেছি একা ছিল।
কানা প্যাঁচা দুবার ডানা ঝাপটিয়ে বলল, ও।
========
পাগল ঘুমিয়ে পড়েছে। লাশ তাকিয়ে শুয়ে আকাশের দিকে। যেন পাহারা দিচ্ছে পাগলকে। চোখের উপর পোকা বসছে, শ্যামা পোকা, লাশ তাও চোখ বন্ধ করছে না। হাতটাও ছাড়ছে না পাগলের। এমন একটা ভালোবাসা যেন চেয়েছিল পাগল।
পাগল স্বপ্ন দেখছে একটা ডিঙি ভাসছে জলে। মাঝগঙ্গায়। সে ডিঙির উপর তার গ্রামের বাড়ির তুলসীমঞ্চ। তুলসীমঞ্চের উপর বাঁশ গাছ। ওই আকাশে উঠে তারা ঘসটাতে ঘসটাতে যাচ্ছে। যেই সূর্যে আঘাত লেগেছে, বাঁশে ধরেছে আগুন। আর তুলসীমঞ্চে। সে চীৎকার করে ডাকছে, মা…ও মা…বাইরে এসো….
সূর্যের আলো পড়ল চোখে। পাগল ধড়ফড় করে উঠে বসল। তার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে লাশ। তাকিয়ে আছে ভোরের আকাশের দিকে। দুর্গন্ধ ফিরে গেছে। ফুলের গন্ধ আসছে। পাগল হাতটা ছাড়িয়ে নিল লাশের হাত থেকে। কুকুরটা ঘুমাচ্ছে। গঙ্গায় নেমে এক হাতেই চোখেমুখে জল দিল। আজ কী বার?
======
পাগল সারাদিন কাঠ জোগাড় করল। এদিকে কেউ আসে না। দুর্গন্ধ ছাড়া। মড়াটাকে পুড়াতে হবে।
চিতা বানালো। তাকে শুইয়ে কাঠের পর কাঠ চাপা দিল। এবার আগুন দেবে।
কিন্তু কী হল? কেউ তো বলেনি তাকে বান আসছে। হুড়মুড় করে জল এসে পড়ল। সব কাঠ ভাসিয়ে মড়াটাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে গেল জলে।
পাগল গলা জল অবধি গেল তার হাতটা ধরতে। একবার ছুঁতে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেসে আছে, যে আকাশের সঙ্গে মাটির কোনোদিন কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাগল হাতটা ধরতে পারল না। ভেসে গেল সে। সব কাঠ নিয়ে।
পাগল তীরে এসে বসল। রাত হল। আবার দুর্গন্ধ এসে বসল তার পাশে। কুকুরটা নেই আজ। ওর যাওয়া আসার ঠিক নেই কোনো। পাগল দড়ি কিনে এনেও বাঁধেনি তাকে কোনোদিন। একবার সারাটা দিন নিজের গলায় দড়িটা বেঁধে, সজনে গাছটার গুঁড়িতে বেঁধে রেখেছিল নিজেকে। এক হাতে গিঁট দিয়েছিল কষে। লাল পিঁপড়ে পাতাল থেকে এসে কামড়ে সারাটা গা ফুলিয়ে দিয়েছিল। তবু পাগল খোলেনি নিজেকে।
আজ হঠাৎ দড়িটার কথা মনে পড়ল। দড়ির ফাঁসে এ রোদমাটির মায়া কাটানো যায়। কিন্তু চায়নি পাগল। এই দুর্গন্ধ, এই ঝোপঝাড়ে জীবনের এমন এক রহস্য লুকিয়ে যা আকাশ জানে না। আকাশের বড় শুচিবাই। চিলের কাছেও নিজেকে আকাশ করে রাখে সে। চিল মাটিতে জন্মেছে বলে। তবু মানুষের যত লোভ আকাশের কাছে। রাতদিন হাত পেতে আছে।
=========
পাগল ভোরের অপেক্ষা করে না। জোয়ারভাটা নিয়ে ভাবনা নেই তার। পাগল একটা ভালোবাসার হাত খোঁজে। যে এসে, তার নেই যে হাত, তার অভাব মেটাবে না, যে হাতটা আছে, সে হাতটা শক্ত করে ধরবে। কিন্তু যে-ই আসে সে-ই প্রশ্ন করে আগে, তোমার ওই হাতটা কই? যেন ওই হাতটা ধরবে বলেই সে এসেছে।
অনেকদিন পর কেউ ধরেছিল তার হাত। তাকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেল জলে। পাগল জলকে অভিশাপ দিল। বলল, তুমিও দিগন্তকে পাবে না কোনোদিন। সমুদ্রে মিশে বুঝবে, দিগন্ত কাছে চায় না কাউকে। ভুল ভাঙবে তোমার, মোহ কেটে নোনতা হবে খালি।