Skip to main content

        আজও কাজে যায়নি। যাবে কি করে, কাজ হলে তো যাবে? সন্ধ্যা কাজে যাওয়ার সময় দেখল মাঠটা পুরো জলে ডোবা। যা বৃষ্টি ক'দিন ধরে পড়ছে, এত জল, বাপ রে! বিষ্ণু'র কাজ তো এই মাঠের থেকে মাটি কেটে লরি ভরতি করা। অত মাটি যায় কোথায় কে জানে? 
        সন্ধ্যার সকাল বিকাল পাঁচটা বাড়ির বাসন মাজা, ঝাঁট দেওয়া কাজ। কাপড় কাচাটা নেয়নি। বাড়ি এসে আবার বড় রান্নাটা করতে হয়। চারটেতে উঠে কয়েকটা রুটি আর তরকারি করে বেরিয়ে আসে। বিষ্ণু আর পরেশ খেয়ে বেরিয়ে যায়। পরেশ সন্ধ্যা আর বিষ্ণুর একমাত্র ছেলে। পরেশ পড়াশোনাটা যে কেন ছাড়ল, সন্ধ্যা এখনও আক্ষেপ করে। তাদের খালপাড়ের জমিটা যেদিন রেজিস্ট্রি হল, সেদিন অফিসের ওই বাবুদের দেখে তার মনে হয়েছিল, ইস্... বাবুটাও যদি এরকম জামাপ্যান্ট পরে অফিসে বসত, কিন্তু সে তো এইটের বেশি আর পড়লই না। এখন টিউবলাইটের চোখ লাগায়। খুব ধৈর্যের কাজ নাকি ও বলে। যা হোক, তার কপাল।
        সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যা বাড়িতে ঢুকেই দেখে বিষ্ণু খাটে বসে জানলার দিকে তাকিয়ে। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, আলো জ্বালেনি বিষ্ণু, বাইরেও আলোটা পড়ে এসেছে। বিষ্ণুর একমুখ দাড়ি, সকালেই দেখে গেছে, কিন্তু মুখটা এত ভার কেন? আসলে বিষ্ণুর হাত ফাঁকা। লাগাতার বৃষ্টির জন্য আজ প্রায় একমাস হল কাজ হচ্ছে না। বৃষ্টি থামল তো মাঠে এক হাঁটু জল। আর সেই জল নামতে না নামতে আবার বৃষ্টি, এভাবে পারা যায়? শাকের বীজ বুনেছিল মৈত্রদের জমিতে ওদের বলে, ঠিক লিজ নেওয়া নয়, ওই মুখের কথাতেই, যেমন ফলন হবে সেরকম কিছু একটা টাকার ভাগ ওরা নেবে। তাও আর হল কই? সব ক'টা শাকের অঙ্কুর হতে না হতেই মরে গেল, পচে গেল। সংসারটা সেই অর্থে সন্ধ্যা আর পরেশই চালাচ্ছে। বিষ্ণুর বয়েস কত হবে, এই তেতাল্লিশ, শরীরের গড়ন রোগাটে হলেও খাটতে পারে প্রচুর। পড়াশোনা ওই ক্লাস ফোর অবধি।
        সন্ধ্যা বিষ্ণুর পাশে গিয়ে বসল। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে, একটা হাত বিষ্ণুর কাঁধে রেখে বলল, কি হয়েছে মশায়ের? এই সময়টা ঘরে কেউ থাকে না। পরেশ ফেরে রাত আটটা নাগাদ। ফিরেই ক্লাবে যায়। পার্টি অফিসে বসে। ওরা একটা চাকরি দেবে বলেছে। লাস্ট পঞ্চায়েত ভোটে পরেশকে দিয়ে ওরা অনেকগুলো দেওয়ালে লিখিয়েছে। ওর হাতের লেখা দারুণ তো।
        বিষ্ণু কিছু বলল না। বিষ্ণুর চারদিনের দাড়িতে ডান হাতটা বোলালো সন্ধ্যা। বিষ্ণু সন্ধ্যার হাতে সাবানের গন্ধ পেল। বাসন মাজার সাবানের গন্ধ। যেদিন তাদের বাড়িতে মাংস হয় না, সেদিনও মাঝে মাঝে বিষ্ণু সন্ধ্যার হাতে মাংসের ঝোলের গন্ধ পায়। বিশেষ করে রবিবারগুলোতে। যে বাড়িগুলোতে কাজ করে কেউ কেউ খেতে দেয় নিশ্চয়। কিন্তু ও সাথে করে আনে না, ভালোই করে, সাথে করে খাবার আনাটা ভালো দেখায় না। আর তিনজনের যখন কাজ থাকে তখন ফি রবিবার মাংস তো হয়েই থাকে। সেরকম একটা লোভ কোন কিছুর ওপরেই নেই বিষ্ণুর, শুধু একটু মাংস আর কোল্ডড্রিংক্স ছাড়া।
        সন্ধ্যা চারদিন আগে বিষ্ণুকে একশো টাকা দিয়েছে। মাসের প্রায় মাঝামাঝি, তারও হাতের টানাটানি। রোজেরটা রোজ কিনতে তার ভালো লাগে না। ওতে লক্ষ্মী থাকে না ঘরে। হোক গরীব, তা বলে সংসারের একটা ছিরিছাঁদ থাকবে না? সে মাসকাবারি চাল, ডাল, নুন, তেল, মশলা এগুলো একবারেই কিনে আনে। বাকিতে কেনাটা বিষ্ণু একেবারে পছন্দ করে না। তাই সন্ধ্যা যতটা পারে নগদেই কেনে। তবু মাঝে মাঝে এক্কেবারেই চলে না যখন বাপি সামলে দেয়, সব মাল তো ওর দোকান থেকেই আসে। তবে কথাটা শুধু তার আর বাপির মধ্যেই থাকে। মাইনে পেলে বাড়ি আসার পথেই বাপির পাওনা মিটিয়ে বাড়ি ঢোকে। বাপি হাসে, বলে, বৌদির কি ঘুম হচ্ছিল না, না ভাত হজম হচ্ছিল না... সন্ধ্যাও হাসে, বলে, জানোই তো তোমার দাদাকে, জানতে পারলে বাড়ি মাথায় করবে।
        বিষ্ণুর হাতে টাকা নেই, সন্ধ্যা জানে। মাথার চুল ঘাড় অবধি এসে ঠেকেছে, ওই টাকা বাঁচিয়ে বিড়ি খাবে, তবু চুলটা কাটাবে না। সন্ধ্যা ব্লাউজের ভিতর থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বার করল। একটা বিষ্ণুর হাতে দিয়ে বলল, যাও দাড়ি চুল ঝরিয়ে এসো। বিষ্ণু টাকাটা নিল, লজ্জা লাগলেও বিড়ি ছাড়া সে আর চলতে পারছে না। বলল, আজ মঙ্গলবার, চুল কাটাটা ঠিক হবে না, কাল বরং যাই।
        বিষ্ণু বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যা জানে বিষ্ণু এখন স্টেশানে যাবে, তাস খেলবে, বিড়ি খাবে। বিষ্ণুর আর কোনো নেশা নেই, এটা সন্ধ্যার বিশাল ভাগ্য সন্ধ্যা নিজে মনে করে। এই লাইনের লোকেদের সে তো দেখেছে, সারাদিন চুর হয়েই আছে, রক্ষা করো বাবা!
        বিষ্ণু কি করে জানতে পারল জানি না, তবে জানতে পারল যে আজ সন্ধ্যা বাড়ি আসার সময় বাপির কাছ থেকে একশো টাকা ধার করে এনেছে। বিষ্ণু স্টেশানে গেল না। মাঠের দিকে গেল। জলে নেমে দেখল প্রায় হাঁটু জল। আকাশ মেঘলা। বিড়ি ধরিয়ে মাঠের ধারে বসল। অন্ধকার এদিকটা। মাঠের ওদিকে একটু পর মদের আড্ডা বসবে। তার মালিকের বড় ছেলেও আসবে। বিষ্ণু উঠে এলো। কি করবে, কোথায় যাবে? এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে বাড়িতেই এলো, বাপির দোকানের রাস্তাটা এড়িয়ে। সন্ধ্যা রান্না করছে। পরেশ আজ ক্লাবে যায়নি, মাথা ধরেছে বলে শুয়ে আছে। সিরিয়াল চলছে। বিষ্ণু গিয়ে সন্ধ্যার পাশে বসল। সন্ধ্যা একটা পিঁড়িতে বসে, তার মা-ও এই পিঁড়িতেই বসে রান্না করত, সব্জী কাটত, মাছ কাটত, মাংস ধুতো। অনেকদিন মাংস হয় না। রাজীবকে বললেই দেয়, রাজীবের মাংসের দোকান বাজারে, তার বন্ধু। থাক। 
       - তুমি বাপির দোকানে গিয়েছিলে?
        সন্ধ্যার বাকিটা বুঝতে দেরি হল না। আড়চোখে বিষ্ণুর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, হাতটা পাতো তো, দেখো তো ডালে নুন হয়েছে কিনা, আমি অবেলায় একটা পান খেয়ে জিভে স্বাদ পাচ্ছি না।
        বিষ্ণু হাত পাতল না। সন্ধ্যার মুখে পানের কোনো দাগ নেই। না তো মুখে কোনো গন্ধ। সন্ধ্যা পান খায় না তা নয়, তবে আজ খায়নি, বিষ্ণু জানে।
        সন্ধ্যা কিছু বলল না। তার চোয়ালটা শক্ত হল। নাকের পাটাটা কিছুটা ফুলছে। একটা কান্নার দমক ডালটা সাঁতলাবার আগেই মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে। বিষ্ণু খেয়াল করল। তার চোখের উপরের পাটাতনটা জ্বালা করল। আর কি উপায় ছিল সন্ধ্যার? হাতটা পেতে বলল, দাও দেখি, তোমার মুখ তো আবার চুনে পোড়া... কে যে খাওয়ায় এত চুন দেওয়া পান...
        বিষ্ণুর ঠাট্টাটায় একটা করুণ সুর ছিল। সন্ধ্যার বুকে বিঁধল, সে নীচের ঠোঁটটা উপরের দাঁতের পাটি দিয়ে চেপে কান্নাটাকে আটকাতে চেষ্টা করল প্রাণপণ, পারল না। দুটো বড় বড় জলের ফোঁটা তার গাল গড়িয়ে মেঝেতে পড়ল। কাঁপা হাতে হাতায় করে একটু ডাল বিষ্ণুর হাতে দিতে গিয়ে খেয়াল করল, বিষ্ণুর চোখের কোনায় এক বিন্দু জল। বিষ্ণু একটা আঙুলে সন্ধ্যার গাল থেকে চোখের জল মুছিয়ে নিজের জিভে দিল, বলল, বেশ, নুনটা ঠিক আছে। কান্না আটকিয়ে, ঢোক গিলে, সন্ধ্যা বলল, মরণ!