Skip to main content

অবশেষে ছোটোমাসিও চলে গেলেন। কত বয়েস হয়েছিল, ৫১/৫২ হবে। সারাটা জীবনের কত নিয়ম, কত বিধান, কত উচিৎ অনুচিত। অথচ সেই জীবনের যে পরম পরিণতি মৃত্যু, তার আসার কোনো বিধান নেই, নিয়ম নেই, সময় অসময় নেই।

        যখন খুব ছোটো, তখন অন্যজগত মানে মামাবাড়ি। মামাবাড়িতে দাদু দিদা মামা মাইমা তো আছেনই, তবে একজনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সাংঘাতিক, আমাদের ছোটোমাসি। তিনি বয়সে আমার থেকে বছর দশেকের বড়। সে হিসাব জানলাম অবশ্য মাত্র কয়েক বছর আগে, মা চলে যাওয়ার পর। কারণ মাসির ব্যক্তিত্ব।
        আমরা ছোটোরা যখন মামাবাড়িতে একসাথে উপস্থিত হতাম, তখন আমাদের উৎপাত সামলানোর ভার ছিল সম্পূর্ণ মাসির উপর। আমার বেশ মনে আছে, আমরা সব জলখাবার খেয়ে খেলেধূলে রেডি হয়ে থাকতাম কখন মাসি কলেজ থেকে ফিরে আমাদের কুয়োপাড়ে নিয়ে যাবে। আমাদের ছোটোদের একলা কুয়োপাড়ে যাওয়া নিষেধ ছিল। মামাবাড়ির কুয়োর সে লোহার চাকা লাগানো কপিকল, জল তুললেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ, অসামান্য লাগত। আমাদের সবক'টাকে নিয়ে মাসি কুয়োপাড়ে যেতেন, আমরা উত্তাল দামালপনা শুরু করতুম, আর মাসি কপট রাগ দেখিয়ে শাসন করে আমাদের বাগে রাখার চেষ্টা করতেন।
        মামাবাড়ির প্রত্যেকের একটা বিশেষত্ব ছিল বা আছে, অসাধারণ গানের গলা। সে লিখতে গেলে এক পর্ব। বড়মাসির শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা, তাও শান্তিনিকেতনের স্বর্ণযুগে বলা যায়, স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রসংগীত তার স্বাভাবিক আয়ত্তাধীন। বড়মামার গজল। ছোটোমামার রফি। মেজোমাসি হিন্দী সিনেমার গানের এনসাইক্লোপিডিয়া। দিদার কথা আগেও লিখেছি, রবীন্দ্রনাথই মূলসুর। দাদুর নানা হিন্দীগান, বাঙালা পুরোনো গান। মায়ের অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত।
        ছোটোমাসির গলায় আমার অত্যন্ত প্রিয় গান ছিল - "মোহে পনঘটপে নন্দলাল ছেড় গেও রে।" এই গানটা শুনিয়ে মাসি আমাদের ঘুম পাড়াতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, একবার মা নাকি গানটা গেয়ে আমায় ঘুম পাড়াচ্ছিলেন, আমি নাকি তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলি, মাসি...
        বড় হলাম। মাসির সাথে পরিচয় আরো গভীর হল। বুঝলাম ইনি আর সকলের চেয়ে দুটো বিশেষ জিনিস বহন করেন, অসম্ভব তীক্ষ্ম স্বাধীন একটা মস্তিষ্ক, আর অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একটা স্থির হৃদয়। মায়ের চোখে ধুলো দিয়েও যে কাজ সারা যেত, তা মাসির চোখ এড়াত না। কিন্তু কঠোরে কোমলে এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার কাছে ভয় ছিল, কিন্তু আতঙ্ক ছিল না।
        মাসি বলতেন, আমার মা, মানে তার 'রা' তার দ্বিতীয় মা। দিদাও তাই বলতেন। "মুন্নি তো আমারই কাছে মানুষ" - মায়ের মুখে বহুবার শুনেছি। যত বড় হয়েছি তত বুঝেছি আসলে আমার মায়ের গর্ভে আমরা দুইভাই জন্মালেও, মাসি তার আগেই জন্মেছেন মায়ের মানসমাতৃত্বে। তখন মাসি যেন আমার দিদি। মায়ের ভালোবাসার ঝোঁক বেশি সেইদিকে দেখে হিংসাও করতুম। মা হেসে বলতেন, ওরে ও যে আমার প্রথম সন্তান, পেটে না ধরলে কি হবে? তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হল মায়ের শেষ কয়েকদিনে।
        মায়ের শরীর অত্যন্ত খারাপ। যে কোনো সময় যা কিছু হতে পারে। আজ হাস্পাতাল থেকে এনেই কাল আবার নিয়ে যেতে হচ্ছে। তবু ছোটোমাসি দেখা করতে আসছেন না। ব্যাঙ্গালোরে থাকেন মাসি।
        কারণটা জানলাম মা যাওয়ার পর। মায়ের যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে মাসি এলেন। আমি বুকের সবক'টা স্পন্দন আঁকড়ে ধরে বসে আছি, কি ঘটবে। মাসি মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, "রা, এই দেখ আমি এসেছি, রা চোখ খোল.. রা.. রা.."
        মা চোখ খুলে তাকালেন। হাসলেন। চোখের কোনা থেকে জলের বিন্দুগুলো ঝরে ঝরে বালিশের ওয়াড় ভেজাতে লাগল। যেন কত যুগ ধরে অপেক্ষা করছিল ওরা।
মা শেষবারের মত হাস্পাতালে ভরতি হলেন পরেরদিনই। দু'দিনের মধ্যে কোমায়। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্নতা ঘিরে থাকে। শেষবারের জ্ঞান ফিরল মির‍্যাকেলের মত। আমরা হাস্পাতালের বাইরে বসে। হঠাৎ একজন দৌড়ে এসে খবর দিল, আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে শীগগির যান। আমি দৌড়ে আইসিইউ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনি মা ডাকছেন, মুন্নী.. মুন্নী...
        পরেরদিন সব শেষ। মাসি বলেছিলেন, আমি এই জন্য আসছিলাম না, আমি জানতাম আমি আসলেই ও চলে যাবে। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই স্বপ্ন দেখছিলাম, তুই আয় মুন্নী, বড্ড কষ্ট পাচ্ছি, তুই না এলে যেতে পারছি না। তাই...
        মাসি কাঁদেননি সে ভাবে। বড়বড় চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল যেন পাথর ডিঙিয়ে বয়ে আসছে মনে হচ্ছিল।
        সেদিন থেকে মাসি মা হলেন আমার। প্রতিদিন নানা ছোটখাটো বিষয়ে ফোন। কষ্ট লাগলে, কোনো বিষয়ে কনফিউজড হলে, মাসির শান্ত মিষ্টি গলার আওয়াজ - হ্যাঁ রে বল।
        পরপর দু'বছর আমরা ব্যাঙ্গালোর গেলাম। বেড়াতে যাওয়া, ঘোরাফেরার কেন্দ্র মাসির সাথে থাকা, ওরফে মায়ের সাথে। সারাক্ষণই প্রায় মা'কে নিয়ে কথা হত আমাদের। কত অজানা গল্প। মায়ের প্রথম জীবনের নানা গল্প। মাসিকে ফেসবুকে আনলাম। একপ্রকার জোর করেই। বেশ কয়েকমাস পর যখন খুব ভালো লাগল, মাসি বললেন, "দেখ জিনিসটা খুবই ভালো। অন্তত একা একা অনুভব করে মন খারাপ করে আর বসে থাকতে হবে না।" আমার কোনো লেখা অপছন্দ হলেই ফোন করে উদুম ঝাড় খেতে হত। কাব্যিক নিয়ামকে না, মাতৃত্বের নিয়ামকে - "অমন মন খারাপ করা লেখা তুমি লিখবে না।"... "বিয়ে করতে পারেন না... উনি ফেসবুকে প্রেমের কবিতা লিখছেন! ডাঁহা মিথ্যাকথা সব!!"


        এখন ফোন নাম্বার, ওয়াটস অ্যাপে শেষ পাঠানো মেসেজ, মেসেঞ্জার ভরতি কথার মালা, কি যে করি ওগুলো নিয়ে! একটা মানুষ যায়, আর একটা সময়কে স্থির করে রেখে যায়। হৃদয়টা মিউজিয়াম হয়ে যায়। রক্তের স্রোত ভালোবাসার স্বাদ বোঝে। তাই নিজের গরজেই সে ছবি মুছতে দেয় না। সময় অসময়ে সেই খাতে গিয়ে বয়। এটাই যদি জীবন হবে তো তাই হোক। বিকল্প তো নেই।