Skip to main content

শশী বাসনপত্র মেজে বাইরের দরজায় তালা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে শুলো। শুতেই পিঠটা টাটিয়ে উঠল। তবু জোর করে পিঠটা চৌকির কাঠের সঙ্গে চেপে রাখলে ব্যথাটা শান্ত হয়ে যায়। শশী অনেক ব্যথা শান্ত করে ফেলেছে এইভাবে, বুকের পাটাতনে চেপে ধরে থেকে। ছটফট করতে করতে ব্যথাটা কইমাছের মত মরে নেতিয়ে পড়ে। শশী ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে। ও, কই মাছ বলতে গিয়ে মনে পড়ল। শশীর হাতের কই খেতে এই হোটেলে কত লোকের যে ভিড় লেগে যায়। আঙুল চাটতে চাটতে কলের দিকে যায় সব।

    শশীর মুখের উপর টালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। শশী ইচ্ছা করেই এইটুকু ফাঁক রেখে দিয়েছে। আজ খুব গরম। ঘুম আসবে না এত তাড়াতাড়ি। শশী চাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে বন্ধ হোটেলের ভিতরটার দিকে তাকালো। কত কম বয়সে সে এসেছিল এই হোটেলে। কুমারদার রান্নার খ্যাতি তখন ক্যানিংএর লোকের মুখে মুখে। কুমারদার সহকারী হয়ে ঢুকেছিল। কুমারদা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেল। এই হোটেলেই একদিন দুপুরে রান্না করতে করতে। হাল ধরল শশী। সবাই ভেবেছিল মাতারা হোটেল ডুবল এবার। শশী মুখ রাখল। মালিক জনার্দন বক্সী তার মাইনে একশো টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিল তাই খুশী হয়ে। 

    হোটেলময় আরশোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওয়াজ পাচ্ছে শশী। এ তো কিছুই নয়, সারাদিন যে কত মানু্ষের হইহট্টগোল লেগেই থাকে হোটেল জুড়ে! এখন কে বলবে এত কিছু হয়ে যায় এইটুকু হোটেলের পেটের মধ্যে। কত ধর্মের মানুষ আসে। খিদের ধর্ম তো এক। শশী শুনেছে বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে খুব গোলমাল হচ্ছে। এখানে এদেশেও হয়। শশী এসবের মানে বোঝে না। এই নিঃশব্দ রাতে, টালিফাটা চাঁদের আলোর মধ্যে শশী জিজ্ঞাসা করে নিজেকে তার ধর্ম কি কাউকে কোনোদিন বোঝাতে পারবে?

    শশী এই তার ধর্মের দিশা পেয়েছে অনেক আগে। সেবারে তার এক বোন মারা গেল দাঙ্গায়। তার এক বন্ধুও মারা গেল দুদিন পরে একই দাঙ্গায়। বোন হিন্দু, বন্ধু মুসলমান। কি লাভ হল? কার লাভ হল? শশী পাগলের মত হয়ে গেল। তখন সে এক কাণ্ড ঘটালো। মন্দিরের এক পুরোহিতকে ধরে, মসজিদের এক মোল্লাকে বলে, আর চার্চের এক ফাদারকে বলে রাতের অন্ধকারে একা একা বসে কাটালো এক এক রাত, এক এক জায়গায়। শুনশান মন্দির, মসজিদ, চার্চের মধ্যে কারোর কোনো শব্দ নেই। অথচ দিন হলেই এক এক জায়গায় এক এক ভাষায়, এক এক নিয়মে চলবে পুজো-আচ্চা। কিন্তু এখন দেখো, সব শান্ত। সব নিস্তব্ধ। শশীর মন ক্রমে শান্ত হল। সে বুঝল ঈশ্বরের আসলে একটাই ভাষা - নিস্তব্ধতা। নইলে কেউ তো কথা বলত। সারারাত চুপ করে থাকত না নিশ্চয়ই।

    শশী সেদিন থেকে কোনো প্রার্থনা করে না, কোনো মন্ত্র পড়ে না, কোনো মন্দির, মসজিদ, চার্চে যায় না। এই রাতের বেলায় সে শুধু নিজেকে শান্ত করে। নিশ্চুপ করে। নিস্তব্ধ করে। এই অন্তর্যামীর ভাষা। এই ঈশ্বর, আল্লাহ, গডের ভাষা। মানুষ বোকার মত রাতদিন কি এক খেলায় মেতে থাকে। হিংসা করবে বলেই যেন ধর্ম করে। নিস্তব্ধ হলেই যে সে শান্তস্বরূপকে পাওয়া যায়, এই কথাটা মানুষ বুঝতে চায় না। এত আঁচ মাথায় তার। বাসনার কয়লায় হিংসার আগুন।

    শশী ঘুমিয়ে পড়ে। চাঁদের আলো সরে যায়। রাতের নিস্তব্ধ তারার আবর্তন ঘুমন্ত শশীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মহাকাশে পাক খায়, নিস্তব্ধ পাদচারণায়।