Skip to main content
 
 
 
লেখক - গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
অনুবাদক - তরুণ কুমার ঘটক
প্রকাশনা - প্রতিভাস
মূল্য - 400/-
 
        বিস্ময়ের সীমারেখা ছাড়ালে এক ধরণের বিস্ময় জন্মায়। তাকে কি বলে আমার জানা নেই। পড়েছি এই বইটা তিনি আঠারো বছর বয়সে নিজের মানসলোকে অঙ্কুরিত হতে দেখেন। কিন্তু সে অঙ্কুরকে একটা বৃক্ষরূপে দেখার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরো কুড়িটা বছর। নিরবিচ্ছিন্ন দেড় বছর প্রয়াসের পর জন্ম নেয় এই বিস্ময়কর সৃষ্টি – শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা।
        বইটার এটি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। এক কথায় অসামান্য অনুবাদ। যে অনুবাদ পড়তে পড়তে ভুলে যেতে হয় আমি একটা অনুবাদ সাহিত্য পড়ছি, রসের এমন সহজ ভাষান্তরণ ঘটানো খুব সহজ একটা কাজ নিশ্চই নয়। আর সে বইটা যদি হয় এই মাত্রার একটা বই। আরো প্রশংসনীয় বইটার কয়েকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাক-কথন, আর বইয়ের শেষে তথা প্রতিটা পরিচ্ছেদের শেষে পাদটিকার সংযোজন। সব মিলিয়ে একটা অত্যন্ত মূল্যবান সংগ্রহ নিশ্চই।
        মূল বইটার সম্বন্ধে বলতে খানিক সঙ্কোচ হচ্ছে। বইটা যে মাত্রায় আলোচিত এবং যাঁদের যাঁদের দ্বারা প্রশংসিত সেখানে আমার কিছু বলতে যাওয়া মানে বাহুল্যের অতিরিক্ত কিছু তো বটেই। বলা হয় বইটা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বইটা নাকি ৩০ মিলিয়নের বেশি বিক্রী হয়েছে আর অনূদিত হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৩৭টি ভাষায়। অনেকেই মনে করেন মার্কেসের নোবেল পাওয়ার একটা প্রধানতম কারণ এই বইটা। এ তো গেলো পরিসংখ্যান, পুরষ্কারের দলিল-দস্তাবেজের গল্প। আচ্ছা যদি এর একটাও পাঠক হিসাবে না জানা থাকত, তবে কি কিছু ক্ষতি হত? হত বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আমার অনুভবটুকু বলি।
 
        বইটা যখন প্রথম পড়তে শুরু করলাম তখন বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ এ ধরণের লেখা পড়ার সাথে পূর্বপরিচিত নই। ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’ – ইত্যাদি পরিভাষায় মস্তিষ্কে আরো গণ্ডগোল পাকিয়ে দিতে শুরু করল। আমি ভাবলাম, মরুক গে ওসব সংজ্ঞা, ধাঁচ, ধরণের ব্যাখ্যায়। আমি আমার মত করে পড়তে শুরু করি। তাই শুরু করলাম। আশি পাতা মতন পড়ার পর বুঝলাম – ‘আমি সম্মোহিত’। একটা রবিবারের সারা সকাল পড়ার পর যখন বন্ধুদের সাথে বাইরে গেছি তখন আমি বুঝতে পারছি আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বটাকে আমি সাথে করে আনতে পারিনি। আমার সত্তার নব্বই শতাংশ পড়ে আছে ‘মাকন্দো’তে, মার্কেসের ভূগোলে এর অস্তিত্ব আছে, অ্যাটলাসের ম্যাপে নেই। আমার চারদিকে যাদের দেখছি সবাই যেন সেই শহরের বাসিন্দা। এমন অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়নি। কোনো চরিত্রের সাথে পথ চলতি কারোর অবয়বের মিল, কিম্বা কথা বলার মিল পেয়েছি কদাচিৎ বা, কিন্তু প্রতিটা মানুষকে কি করে মনে হতে পারে? পারে। কেন পারে বুঝলাম। আসলে উপন্যাসটার প্রধান চরিত্র মানুষের নিঃসঙ্গতা। যা মার্কেসের ভাষায় চুলকে চুলকেও তুলে ফেলা যায় না। সাতটা প্রজন্মের উপাখ্যান। প্রজন্মের পর প্রজন্মের নাম এক এক করে ঘুরে ফিরে আসছে – হোসে আর্কাদিও, আউরেলিয়ানো, রেমিদিওস, উরসুলা ইত্যাদি। মাকন্দো যেন মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের একটা ক্ষুদ্রতম পথ নাটিকার মঞ্চ। সে নাটিকার কেন্দ্রে একটা অদৃশ্য চরিত্র – নিঃসঙ্গতা। সে নাটিকার সব রঙের মধ্যে প্রধান রং - নারীত্ব আর মাতৃত্বের আদিমতম প্রতীক, তার নাম – উরসুলা। সে ছ'টা প্রজন্মের সাক্ষী। আর সাক্ষী মানুষের আদিম রিপুর বল্গাহীন তাড়নার সাক্ষী মাকন্দোর প্রায় বারবণিতা হয়ে যাওয়া – পিলার তেরনা। যেও প্রায় ছয় প্রজন্মের সাক্ষী। ধর্ম এলো, বিজ্ঞান এলো, রাজনীতি এলো। নিঃসঙ্গতার বাঁক কখনও ক্ষমতা, কখনও ধর্মভীরুতা, কখনও ব্যাভিচারিতা, কখনও উগ্র কাম লালসা, কখনও আত্মমগ্নতায় নানা চরিত্রে বয়ে চলতে লাগল। তার উর্মিমালার নীরব সাক্ষী উরসুলা। তার ধাক্কা মাঝে মাঝে গিয়ে লাগে পিলার তেরনার নিঃসঙ্গ শয্যাতেও। ক্ষমতার লড়াইয়ের সাথে ভালোবাসা আর মৃত্যুও ঘুরে বেড়ায় মাকন্দোর মাটিতে, আকাশে, বাতাসে। প্রতিহিংসা, ভয়, আতঙ্ক লোভের পাশাপাশি নীরব আত্ম-বলিদান, ধৈর্য-স্থৈর্য্যের মানবিক চরিত্রও আঁকা হয়ে যায় মার্কেসের যাদু কলমের আঁচড়ে। ক্রমে সব উপন্যাসে যা হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়। নিয়তি, ভবিতব্য আর মানুষের অন্তঃকরণের রহস্যময়তা মিলে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের মধ্যে মানুষের সার দিয়ে চলা কালের শোভাযাত্রাটাকে কখনও শরতের মেঘের মত উজ্জ্বল আলোয়, কখনও আচমকা ঝড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, কখনও হড়পা বানে গতি বদলিয়ে নতুন খাতে নিয়ে যায়। ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। মানুষ নিজেই হিসাব মেলাতে পারে না – আসলে সে কতটা স্বাধীন? নাকি স্বাধীনতার অনুভবটা একটা চুষিকাঠি মাত্র? সে কি কালের সাগরে একটা ছোট্ট নিঃসঙ্গ ডিঙি? তার হাল, দাঁড়, পাল নেই তা নয়, তবে তারা কতটা কার্যকরী আর কতটা সীমায়িত তার হিসাব বুঝতে মানুষের একটা আয়ু ফুরাবার সময় হয়।
        “অসীম ক্ষমতার একাকীত্বের গভীরে ঘুরপাক খেতে খেতে সঠিক যাত্রাপথটি হারাতে শুরু করে কর্ণেল আউরেলিয়ানো”... ”৩২টা যুদ্ধ তাকে বাধাতে হয়েছিল আর মৃত্যুর সাথে সব চুক্তিভঙ্গ করেছে সে এবং খ্যাতির বিষ্ঠায় শুয়োরের মত গড়াগড়ি করেছে, চল্লিশ বছর তার বুঝতে লেগেছে – সারল্য কত সুখকর” ... ”সে ভাবতে পারেনি যে যুদ্ধ শেষ করার চাইতে অনেক সহজ শুরু করা”...
        এমনই এক যোদ্ধার অনুভব।
        এক শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ নারী স্নানরতা। মার্কেসের ভাষায়, “একদিন চান শুরু করবে এমন সময় এক আগন্তুক ছাদে উঠে একটা টালি সরিয়ে তার নগ্ন দেহের ঐশ্বর্য দেখে শ্বাসরুদ্ধ বিস্ময়ে কাতর হয়ে পড়ে। সুন্দরী রেমেদিওস ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে ওই নিঃসঙ্গ চোখদুটো দেখে, সে লজ্জা পায় না, ভয় পায়।
- সাবধান – চেঁচিয়ে ওঠ সে – পড়ে যাবেন না যেন
- শুধু দেখতে চাই, আর কিছু না – অস্ফুটে বলে সেই আগন্তুক
- আহা, ভালো – সে বলে – কিন্তু সামলে দেখুন, ওই টালিগুলো পচা।“
 
        মার্কেস এমন করে দৃশ্যপট আঁকেন। “লোকটা যাতে বিপদে না পড়ে সেইজন্যে সে অন্যদিনের তুলনায় দেরি না করে জল ঢালতে শুরু করে দেয়”। মার্কেস বলেন।
সংসারের আটপৌরে অভিজ্ঞতাকেও মার্কেস আঁকেন এরকম ভাবেই- “পুরুষের কামাবেগ একবার তৃপ্ত হওয়ার পর কোনো অবহেলা (নারীর তরফ থেকে) পুরুষ সহ্য করবে না, বোধবুদ্ধিতে যে ফাঁকি ধরা পড়ে না তাও কোনো পুরুষ মেনে নেবে না”।
 
        মার্কেস নিঃস্পৃহ, নিরাসক্তভাবে কালের কলমের বকলমে বলেই চলেন বলেই চলেন। মার্কেস কালের মতই নিষ্ঠুর, নির্দয়, পক্ষপাতহীন। প্রতিটা মানুষ জন্মসূত্রে নিঃসঙ্গতাকে লাভ করে। তার সাথে যুদ্ধ করে। তাকে ভয় করে। তার সৃষ্টি ভুত-ভগবান, প্রকৃতির গর্ভজাত প্রেম-কাম-ক্ষমতা তাকে আত্মবিস্মৃতির মোহের জালে আটকায়। পিছন থেকে গুটি গুটি পায়ে আসে মৃত্যু। হঠাৎ সে মোহের জাল ছিন্ন করে অট্টহাস্যে তার কানের পর্দা চিরে হৃৎপিণ্ড ফাটিয়ে দেয়।
        আবার নতুন করে আরেক উপাখ্যান কোথাও শুরু হয়।
 
 

Category