Skip to main content


আচ্ছা আমি এরকম কেন বলতে পারো?, বলে নিশীথ আমার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে থাকল।
নিশীথ আমার বহু পূর্বপরিচিত। আমাদের কলেজের অনেক জুনিয়ার ব্যাচ। কলেজের সমাবর্তনে আলাপ হয়েছিল। খুব ভাল গান গেয়েছিল বলে যেচেই আলাপ করেছিলাম।
      আজ বছর চারেক পর সে দেখা করতে এসেছে। মাঝে অনলাইন কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার অবশ্য। ওর বয়স এখন পঁচিশ। বেকার।
      আমি কিছু বললাম না। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি বলব।
জানো দাদা, আমি নিজেকে অনেকদিন ঠিক রাখার চেষ্টা করেছিলাম। অনেকদিন। ভেবেছিলাম কাউকে একজন পাবোই আমার মনের মত। যে আমাকে ভালবাসবে। আমার শরীরকে নয়। হল না। মন অপেক্ষা করতে পারে দাদা, শরীর নয়। আর এখন তো কত সুযোগ, কত হাতছানি, হাজার একটা প্রলোভন।
      আমি এবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। চোখে হাল্কা কাজলের রেখা। মুখের আদল, শরীরের গড়ন যেন বিধাতা মেয়ে গড়তে গিয়ে হঠাৎ করে ছেলে বানিয়ে ফেলেছেন অন্যমনস্কতায়। ওর কথা বলার ভঙ্গী, হাত পা নাড়ার মধ্যেও একটা নারীসুলভ আচরণ আছে, এতদিন খেয়াল করিনি।
      বলল, এক অর্থে আমি এখন বেশ্যা।
      ওর চোখের কোল কাজল ভিজিয়ে জল গড়িয়ে দিল গালে।
      আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। কি বলব। আমি কি সত্যিই বুঝতে পারছি কিসের ওর অভাব? না বোধায়। কারোর কষ্টকে বুঝতে না পারলেই তাকে লঘু করে দেখাটা খুব অন্যায় বলে মনে হয়। আমি শুধু বললাম, পড়াশোনা ছাড়লে কেন?
      বলল, ছাড়িনি। তবে খুব যে পড়ছি তাও না। দেখি ছোটখাটো একটা চাকরী পাই কি না। বাড়ির অবস্থাও ভাল না দাদা। বাবা চলে যাওয়ার পর বুঝলাম, আমাদের সঞ্চয় প্রায় শূন্য। এভাবেও কিছু টাকা পাই জানো। কত বিবাহিত পুরুষও বাড়িতে বউ না থাকলে ডাকে তুমি অবাক হয়ে যাবে দাদা। এক এক সময় মনে হয় সবার মুখোশগুলো খুলে দিই। কিন্তু কি হবে বলো। যা টাকা পাই তাতেই মোটামুটি চালিয়ে নিই। মা বুঝেও না বোঝার ভাণ করেন। কি আর করবেন বলো?
      আমি তার জন্য তোমার কাছে আসিনি। আমি এসেছি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। তুমি তো অনেক বই পড়ো। তুমিই বলতো। একজন ছেলের শরীরে একটা মেয়ের মন কেন জুড়ে দিলেন ভগবান? সমাজে ছেলের আর মেয়ের নির্দিষ্ট কাজ আছে, দায়িত্ব আছে, জীবন আছে। আমাদের? আমাদের কি আছে বলতে পারো? আমার বেণারসী পরতে ইচ্ছা করে, সাজতে ইচ্ছা করে, একটা সংসার করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কিচ্ছু হবে না। না পারবো একটা সম্পূর্ণ ছেলে হতে না পারব সম্পূর্ণ একজন মেয়ে হতে।
      এবার সে সত্যিই কেঁদে ফেলল। আমি ভাবলাম উঠে ওর গায়ে হাত রেখে বলি, কাঁদিস না। উঠলাম না। কাঁদুক। হাল্কা লাগবে। আমার মন বিস্মিত, হতভম্ব। একজন ছেলের শরীরে এরকম একটা পরিপূর্ণ নারীসত্তা বাস করে কি করে!
      ও আবার বলল, আমি গলায় দড়ি দিতেও গিয়েছিলাম জানো, সারারাত দড়িটা কোলের উপর নিয়ে বসে থাকলাম। পারলাম না। আমি বড্ড ভীতু। বাঁচার লোভ ছাড়তে পারি এতখানি সাহস জোগালো না দাদা!
      আমি বললাম, মরবে কেন? নিজেকে মেনে নিতে চেষ্টা করো। কেউ না কেউ আসবেই যে তোমায় বুঝবে।
      সে হাসল। বলল, আসলে কি জানো, আমরা নিজেরাই নিজেদের ঘেন্না করি মনে মনে। তাই কাউকে ভালবাসা বা তার পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবতেও পারি না। অবশ্য সবাই না। কেউ কেউ বেরিয়ে আসে, মিছিল করে, ক্লাবে যায়। সবই জানি। আমি কেন জানি পারি না। আর তোমরা কি করবে, বড়জোর করূণা করে কিছুক্ষণ আমাদের কথা শুনবে, বুঝবে কি?
      আমার মনে হল আমি যেন ধরা পড়ে গেলাম হঠাৎ। লজ্জা লাগল খুব।
      সে বলল, তোমার কাছে আরো কেন এলাম জানো? তুমি তো লেখো। আমার এই কটা কথা একটু লিখবে? আমি গুছিয়ে লিখতে পারি না।
      নিশীথ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। কেন এমন হয়? যখনই মনে হয় মানব চরিত্রের অনেকটা বুঝে উঠতে পেরেছি ঠিক তখনই একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে মুখের সামনে হাসতে থাকে। অহংকারটা মুখ থুবড়ে পড়ে। সত্যিই কি বুঝলাম এতদিনে? কত বিচিত্র সুখ আর দুঃখকে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে চলেছে এ জগৎ সংসার। কতটুকুই বা বুঝি তার?