মানুষের জীবনে এক শূন্য পাড়া আছে। আমার সেই শূন্য পাড়ায় ভীষণ ভয়। দিকশূন্যপুরে ভয় নেই। নিঃসঙ্গতার ভয়ও তেমন বিশেষ করে পাই না। কিন্তু শূন্য পাড়ার ভয় আমার ভীষণ।
আজীবন নিজেকে ঠিক জেনে, নিজেকে নির্ভুল জেনে, নিজেকে অজেয় জেনে মানুষ সেই পাড়ায় গিয়ে পৌঁছায় অবশেষে। গোটা পথের উজ্জ্বলতা, গোটা পথের আশ্বাস, গোটা পথের সঞ্চয়, সাজসজ্জা… শূন্য এক লহমায়। এই সেই শূন্য পাড়া।
নিজেকে প্রতিমুহূর্তে নির্মম সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখার তপস্যা, একটা একটা করে মোহ ভেঙে পড়ার, আশ্বাস ভেঙে পড়ার তপস্যা এ জীবন। পথের ধারে বাঁশি না বাজুক, সামনে পেছনে কোনো অনুরাগী না আসুক, কোনো শিরোপা, কোনো ভূষণে ভূষিত না হই, সমস্তটা পথ যদি কাঙাল হয়ে যাওয়ার আছে তাই যেন যাই। ঈশ্বরত্ব স্পর্শের মোহ, দৈবী ভালোবাসার মোহ, নিজেকে নিয়ে যাবতীয় মোহ যেন প্রতিদিন শুকনো পাতার মত একটা একটা করে খসে পড়ে। সুখ চাই না। আরাম চাই না। যা চাই তা হল, সেই শূন্য পাড়ায় গিয়ে জীবন যেন না ঠেকে, যেখানে আমারই মোহে লালিত আমারই অহংকার, দরজায় রেখে মিলিয়ে যায়। আমি বসে থাকি একা। নিজের যাবতীয় নির্বোধ উচ্চকিত স্বরে উচ্চারিত বাক্য আর কাজের ইস্তাহার নিয়ে। যা দেখার কেউ নেই। এমনকি নিজেরও ফিরে দেখার রুচিটুকু নেই।
সে নির্বোধ সত্তার মরণ হয় না। ধ্বংস হয় না। শূন্য বাতাসে অসীম শূন্যতার হাহাকার, একা একা যার নাম নিয়ে ডেকে যায় সে আমি নই। কে আমি তবে? কোনোদিন খোঁজ নিয়ে দেখিনি। প্রতিদিন শুধু নিজেকে অর্থে-খ্যাতিতে-ঈশ্বরত্বে নির্মাণ করার মোহে কী ভীষণ খেলায় মেতেছিলাম। আজ সব শূন্য! সব অর্থহীন। সব প্রহসন। সেই শূন্য পাড়ায়।
ভয় শুধু এই। এর চাইতে শেষ মুহূর্তে যদি সব যায়, যদি পরম নিঃসঙ্গতায় বসে থাকি একা, তবু সে একাকীত্বর থাকবে মান। কারণ সে একাকীত্বর আর কিছু না থাক, তার নিজের সঙ্গে নিজের সত্য সম্পর্ক আছে। বিশ্বাস করি, যার সত্য আছে, তার সব আছে!